বাংলাদেশে রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বাধীন ব্রিকস জোটের ব্যাংক অনুমোদন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.11.13
ঢাকা
বাংলাদেশে রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বাধীন ব্রিকস জোটের ব্যাংক অনুমোদন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনে অংশ নেয়া অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে ফটোসেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (সামনের সারি, ডানে) ২৪ আগস্ট ২০২৩।
[সৌজন্যে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়]

রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বাধীন জোট ব্রিকসের সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক থেকে ঋণ পেতে সোমবার প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে বাংলাদেশ।

সরকারের মতে, এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব‌্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব‌্যাংকের পাশাপাশি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন‌্য ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর মাধ‌্যমে একটি বিকল্প উৎসের পথ বের হলো।

তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক থেকে নেওয়া ঋণে সুদের হার বেশি হবে এবং সংস্থাটি বিশ্বব‌্যাংকের মতো বাংলাদেশের সামাজিক খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দেবে না। ফলে বিশ্বব‌্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব‌্যাংকের বিকল্প হবে না নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক।

গত পহেলা নভেম্বর সংসদে নিউ ডেভেলপমেন্ট বিল, ২০২৩ পাশ হয়।

সোমবার এতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বাক্ষর করায় বিলটি “আইনে পরিণত হলো” জানিয়ে সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) মো. নাজমুল হক বেনারকে বলেন, “আশা করা যায়, আজকের মধ‌্যেই গেজেট প্রকাশিত হয়ে যাবে।”

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান বেনারকে বলেন, বিশ্বব‌্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব‌্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংকও “উন্নয়ন প্রকল্প অর্থায়নের জন‌্য আমাদের আরেকটি বিকল্প উৎস।”

“আমাদের কাছে যত বিকল্প থাকবে, ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তত বেশি সুবিধা পাব,” বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

সংসদে পাশ হওয়া বিল আইনে পরিণত হবার আগেই ৯ নভেম্বর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক স্থাপন সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, “বর্ধিত ঢাকা পানি সরবরাহ রেজিলিয়েন্স” প্রকল্পের মোট খরচ চার হাজার ৪০ কোটি টাকা; যার মধ্যে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক দেবে তিন হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত।

“এটিই বাংলাদেশে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া প্রথম প্রকল্প,” উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “আমরা আশা করছি, ভবিষ‌্যতে এই ব‌্যাংক থেকে বাংলাদেশ আরও বেশি ঋণ পাবে।”

‘শুধু অবকাঠামোতেই বাণিজ্যিক ঋণ পাওয়া যাবে’

নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংকের সদস‌্য হওয়ায় বাংলাদেশ একটি বিকল্প উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ পেলো বলে সোমবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম।

তাঁর মতে, এর ফলে “প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।”

তবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক “মূলত অবকাঠামো অথবা নগরায়নের সমস‌্যা সংক্রান্ত প্রকল্পে ঋণ প্রদান করে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিশ্বব‌্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব‌্যাংক ও অন‌্যান‌্য সংস্থাগুলো শিক্ষা, সামাজিক খাত, দরিদ্র্যতাসহ বিভিন্ন সমস‌্যা সমাধানে স্বল্প সুদে (কনসেশনাল লোন) ঋণ দেয়।”

“নিউ ডেভেলপমেন্ট বাণিজ‌্যিক ঋণ দেওয়ার কারণে এর সুদের হার অনেক বেশি,” বলেন তিনি।

নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক কী?

পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে গঠিত বিশ্বব‌্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব‌্যাংকের বিপরীতে পশ্চিমাবিরোধী দেশ রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক জোট ব্রিকসের সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংক গঠিত হয় ২০১৪ সালে। ব্রিকসের সদস‌্য রাষ্ট্রগুলো হলো—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

সংসদে পাস হওয়া আইনের যথার্থতা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তফা কামাল লিখিতভাবে জানান, ব‌্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ৫০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ‌্যে পেইড-ইন-শেয়ার ১০ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণ সংক্রান্ত (কলেবল শেয়ার) ৪০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ‌্যে বাংলাদেশের মোট শেয়ারের পরিমাণ নয় হাজার ৪২০ ডলার এবং চাঁদার পরিমাণ ৯৪২ মিলিয়ন ডলার।

অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ‌্যাকসেশন স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব‌্যাংকের সদস‌্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ।

তবে ব‌্যাংকের আর্টিকেল অব এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন।

এই আইনের মাধ‌্যমে বিশ্বব‌্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব‌্যাংকের মতো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও বাংলাদেশে উন্নয়ন অর্থায়নের জন‌্য একই মর্যাদা, দায়মুক্তি, সুযোগ-সুবিধা এবং কর-ভ‌্যাট থেকে অব‌্যাহতি পায়।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের মতবিরোধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকে।

এই প্রেক্ষাপটে এ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান দেশটির রাষ্ট্রপতি। সেই আমন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ব্রিকসের সদস্যপদ দেওয়া হতে পারে বলে জোরাল আলোচনা থাকলেও তখন সদস্যপদ পায়নি বাংলাদেশ।

তবে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে বলেন, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য পদ পাওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি।

তবে “ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য পদ পাবে” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান।

এছাড়া “বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কখনো খারাপ হয়নি,” বলেও দাবি করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।