ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে নদীপথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ খননের কাজ পেয়েছে একটি চীনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রায় ৬০২ কোটি টাকা মূল্যের “বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন প্রকল্প-১” এর এই কাজটি পায় চীনা কোম্পানি চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন।
বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী।
বাংলাদেশ পদ্মাসেতু, পদ্মাসেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ সড়ক ও রেল বিভাগের অনেকগুলো বড়ো বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি।
তবে গত এক দশকের মধ্যে নদীপথের উন্নয়নে এই প্রথম কোনো চীনা কোম্পানি কাজ পেলো বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা।
বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তিন হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে “বাংলাদেশ রিজিওনাল ওয়াটারওয়ে ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পটি” বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও এই প্রকল্পের উপ-পরিচালক এ এইচ এম ফরহাদউজ্জামান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আজকে এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-আশুগঞ্জ নৌপথ খনন ও টার্মিনাল নির্মাণ কাজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই অংশের কাজের আওতায় ১৯টি নদীতে ৮০০ কিলোমিটার নদী খনন করা হবে, যার ফলে নদীতে নৌযান চলাচল করতে পারে।”
প্রকল্পের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শুরু হয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে বলেও জানান” জানান ফরহাদউজ্জামান।
“নদী খননের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর পণ্যবাহী জাহাজ সহজে বাধা ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার পানগাঁ কন্টেইনার টার্মিনালে আসতে পারবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে,” বেনারকে বলেন বিআইডব্লিউটিএ’র সদস্য ও যুগ্মসচিব মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, “নদী খননের এই কাজের মাধ্যমে আখাউড়া নদীবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে দেশে ৪০৫টি নদী রয়েছে যার মধ্যে ৫৭টি সীমান্ত নদী, যেগুলোর ৫৪টি ভারত থেকে এবং তিনটি এসেছে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের প্রধান তিন নদী গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী ভারত থেকে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে।
সাগরে মিশে যাওয়ার আগে সবগুলো নদীর প্রচুর পরিমাণ পলি তলদেশে জমে নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে অনেক সময়ই নৌ-যান চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে বাংলাদেশে মোট ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার নৌ পথ রয়েছে, যার শতকরা ৪০ ভাগের গভীরতা পাঁচ মিটারের কম। প্রতিবছর নদীগুলো দিয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন টন পলি বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যার অধিকাংশই তলদেশে জমা হয়।
সেকারণেই নদীপথ সচল রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
![চাঁদপুর সংলগ্ন মেঘনা নদী পাড়ি দিচ্ছে বালুবাহী একটি ট্রলার। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। [শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]](/resizer/v2/WXCCY7B2CMW2Q5YJIRMUOQJMCI.jpg?auth=3f2be8b844fe22bd190653db1f1ccd7cb0e0950a7cfae39940fec989829d5231&width=800&height=449)
বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাত রাজ্য ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। বাংলাদেশ এই সাত রাজ্যকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে।
মূল ভূখণ্ড থেকে এই সাত রাজ্যে পৌঁছাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়ি করিডোর অথবা ‘চিকেননেক’ নামক সংকীর্ণ ভূমি দিয়ে যেতে হয়।
মূল ভূখণ্ড থেকে এই রাজ্যগুলোতে ভারতীয় পণ্য পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশি পণ্য এই সাত রাজ্যে সস্তা এবং রাজ্যগুলো বাংলাদেশি পণ্যের একটি ভালো বাজার। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে খুব সহজেই খুব কম খরচে ভারতীয় পণ্য ওই সাত রাজ্যে পোঁছানো সম্ভব।
সেকারণে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মধ্য ট্রানজিট সুবিধা দাবি করে আসছিল ভারত সরকার। বাংলাদেশ ২০১১ সালে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিলেও উপযুক্ত সড়ক, রেল ও নদীপথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় ট্রানজিট কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়নি।
ট্রানজিট সুবিধার জন্য আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প চলমান। এই রেল সংযোগ বাস্তবায়িত হলে ভারত থেকে রেলপথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে সরাসরি পণ্য সরবরাহ করতে পারবে ভারত।
বাংলাদেশকে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে সরাসরি সংযোগকারী আশুগঞ্জ-আখাউড়া এক লেনের সড়কটি চারলেন করার প্রকল্প চলমান। এটি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা।
তা ছাড়া “বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন প্রকল্প-১” প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভারতের কলকাতা বন্দর থেকে নদীপথে আখাউড়া নদীবন্দরে পণ্য নিয়ে আসবে ভারতীয় জাহাজ। সেখানে খালাসের পর পণ্য ও কাঁচামাল সড়কপথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। কারণ আখাউড়া থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার।
এ ছাড়া, নদীবন্দর দিয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চলগুলো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-আশুগঞ্জ নদীপথ খননের প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে সেটি অনেক বছর ধরে আলোচিত হচ্ছে বলে বেনারকে জানান নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমোডোর (অব.) সৈয়দ আরিফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো, ভারতের ল্যান্ডলকড সেভেন-সিস্টার্স নামক উত্তর-পূর্ব রাজ্যের সাথে নদীপথে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন।”
সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, “পলি জমে আমাদের নৌ-পথ খুব তাড়াতাড়ি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। আবার উজান থেকে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে সেগুলোর সবটুকু সাগরে চলে যায় না। সকল রুটে ড্রেজিং করা সম্ভব হয় না। ফলে নৌ-পথ ব্যবহার করে আমরা কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য সুবিধা পাই না।”
তিনি বলেন, “এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসকল সীমান্ত নদী রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করে দুদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসতে পারে। একইসাথে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে।”
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সাথে সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলো দুদেশের মধ্যে “ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে,” বলে বেনারকে জানান ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন।
তিনি বলেন, “যোগাযোগের সকল মাধ্যমের মধ্যে নদীপথ সবচেয়ে সস্তা। নদীপথে পণ্য পরিবহন খরচ সবচেয়ে কম। ফলে এই মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।”
“আমাদের অনেক নদীর নাব্যতা কমে গেছে, উজান থেকে পানি কমে এসেছে। তবে যদি বাংলাদেশ-ভারত দুদেশ একসাথে কাজ করে নদীতে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করে নদীপথ সচল রাখা যায় তাহলে ব্যবসার পাশাপাশি আমাদের নদীগুলো রক্ষা পাবে, মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে,” বলেন মীর নাসির।