চট্টগ্রামে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সহিংসতা: গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক এলাকাছাড়া

শরীফ খিয়াম
2021.04.19
ঢাকা
চট্টগ্রামে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সহিংসতা: গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক এলাকাছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে নিহত পাঁচ শ্রমিকের একজন রেজার লাশের পাশে স্বজনদের আহাজারি। ছবিটি বাঁশখালী উপজেলা হাসপাতাল থেকে তোলা। ১৭ এপ্রিল ২০২১।
[বেনারনিউজ]

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে চীনের সহায়তায় নির্মাণাধীন বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় সোমবার রাত আটটা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে যেখানে আসামির সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি।

বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল কবির বেনারকে জানান, পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে শনিবার রাতেই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রাশেদ বাদী হয়ে আড়াই হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। 

“এর কিছুক্ষণ পরই যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও মালামাল লুটপাটের অভিযোগে নির্মাণাধীন প্ল্যান্টের প্রধান সমন্বয়ক ফারুক আহমেদ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো এক হাজারের বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন,” জানান তিনি। 

এসব মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি উল্লেখ করে সোমবার ওসি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে পুলিশ। 

তবে মামলা দায়ের হওয়ার পর শ্রমিক ও স্থানীয় এলাকাবাসীদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। 

মামলার অন্যতম আসামি আলী হায়দার আসিফ ওই ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা কর্মকর্তা। 

সহিংসতার দিন ঘটনাস্থলে ছিলেন না দাবি করে বেনারকে তিনি বলেন, “আমার মতো যেসব স্থানীয়রা এখানে কাজ করে তাদের অনেককে আসামি করা হয়েছে। এমনকি কাজ করে না এমন এলাকাবাসীর নামও রয়েছে মামলার এজাহারে।” 

মামলার পর ধর-পাকড়ের ভয়ে শ্রমিকদের অনেকেই রাতে এলাকায় থাকছেন না বলে জানান আসিফ। 

চলমান লকডাউনের মধ্যেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে নিজ গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন মশিউর রহমান নামে এক শ্রমিক। 

“আমার মতো আরো অনেকেই এভাবে পালিয়েছে,” বেনারকে বলেন মশিউর। 

হামলা ও হতাহতের বিষয়ে জানতে চাইলে এসএস পাওয়ার প্লান্টের কর্মকর্তা প্রধান সমন্বয়ক ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “ঘটনা অনুযায়ী মামলা হয়েছে, এটুকুই শুধু বলতে পারি আমি।” 

বেনারের হাতে থাকা মামলার এজাহারটিতে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসএস পাওয়ার প্লান্টের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ, প্লান্টের বিভিন্ন স্থাপনা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর করে ক্ষতিসাধন ও মালামাল চুরির অভিযোগ করা হয়েছে। 

১০ কোটি টাকার মালামাল লুট হওয়ার কথা উল্লেখ করে মোট ১৫ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই মামলায়। 

এ ঘটনায় ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে প্রশাসন ও পুলিশের গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি। পাওয়ার প্ল্যান্টটির বাংলাদেশি অংশীদার এস আলম গ্রুপও সোমবার ঢাকা থেকে একটি তদন্ত দল পাঠিয়েছে। 

তদন্ত দলটির প্রধান ও এস এস পাওয়ারের চীফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) ইবাদাত হোসেনের মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে এবং একাধিকবার যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

তবে ধর-পাকড়ের ভয়ে শ্রমিকদের এলাকা ছাড়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে ওসি বলেন, “প্রায় এক হাজার দুইশ শ্রমিক প্রকল্প এলাকায় ফিরে এসেছে। কিন্তু তাদের আবাসস্থলের মালামাল লুটপাট হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সেগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। যে কারণে প্লান্টের নির্মাণ কাজ আপাতত বন্ধ আছে।” 

চীনা নাগরিকেরা প্লান্টেই অবস্থান করছে জানিয়ে ওসি বলেন, তাঁদের নিরাপত্তা জোরদার করতে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

ঘটনার দিন শনিবার বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবস্থানকারী চীনা নাগরিকদের সুরক্ষার স্বার্থেই গুলি চালানোর কথা বেনারকে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এই বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে ই-মেইল পাঠিয়েও সাড়া পাননি বেনার প্রতিনিধি। 

চীন–বাংলাদেশের সম্পর্ক এ ঘটনায় প্রভাব ফেলবে কিনা, চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা বা চীনের বিনিয়োগ সুরক্ষাসহ হতাহতের ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বা সচিবের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হলেও তা পাওয়া যায়নি। 

‘আইনি লড়াইর পরিবেশ নেই’

শুরু থেকে গণ্ডামারার ঘটনাটি পর্যবেক্ষণকারী রাষ্ট্রচিন্তা নামক একটি ‘রাষ্ট্রনৈতিক’ গোষ্ঠীর সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বেনারকে বলেন, “পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো পরিবার বা ব্যক্তির আইনি লড়াই করার মতো পরিবেশ বাংলাদেশে নেই।” 

“তাঁদের নানা হুমকি-হয়রানীর মুখোমুখি হতে হবে। অতীতে এ জাতীয় ঘটনায় যারা পুলিশ বা মালিকপক্ষে বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তারা এমনটাই জানিয়েছেন আমাদের,” বলেন তিনি। 

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সামর্থ্যটাই শ্রমিক পরিবারের থাকে না। কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা পাশে দাঁড়ালে কিছু কাজ হয়,” বলেন তিনি। 

এই ঘটনায় নিহতদের তিন লাখ ও আহতদের ৫০ হাজার করে টাকা দেওয়ার ঘোষণার কথা উল্লেখ করে কাইয়ুম বলেন, “এটা কিন্তু এখনই দেবে না, ঝুলিয়ে রাখবে। যাতে পরিবারগুলো তাদের বিরুদ্ধাচারণ না করে।” 

নিহত শ্রমিকদের একজন আহমেদ রেজা পূর্ব বড়ঘোনারই বাসিন্দা ছিলেন। মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাতে কিছুদিন আগে এই কেন্দ্রে কাজ নিয়েছিলেন জানিয়ে তাঁর মামা মো. ফরহাদ উল্লাহ মুঠোফোনে বেনারকে বলেন, “আমরা অসহায় গরিব মানুষ। আমাদের মামলা চালানোর সামর্থ্য নেই। যে কারণে আমরা আল্লাহর দরবারে মামলা দিয়েছি। আমার ভাগিনা রোজাদার অবস্থায় নিহত হয়েছে, আল্লাহ এর বিচার করবে।”

এদিকে নিহতের প্রত্যেকের পরিবারকে তিন কোটি এবং আহতদের দুই কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, আইন মন্ত্রণালয় সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয় সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের রবিবার এক আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। 

আসকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিনের পাঠানো ওই নোটিশে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে। 

দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন। 

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানায় নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে শনিবার পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু হয়, আহত হয়েছে তিন পুলিশসহ অন্তত ১৫জন। 

চীনের ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণের ঘটনায় ২০১৬ সালে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হন। 

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ এস আলমের ৭০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে এসএস পাওয়ারে। এ ছাড়া চীনের সেপকো থ্রি ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ২০ শতাংশ ও এইচটিজি ডেভলপমেন্ট গ্রুপের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। 

এস এস পাওয়ার লিমিটেডের ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলারের প্রকল্প। এর ৭০ শতাংশের বেশি ঋণ হিসেবে আসছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে। 

প্রকল্পটিতে বর্তমানে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি ও প্রায় এক হাজার চীনা শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।