বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে সহিংসতা: পুলিশের গুলিতে আহত দুই শ্রমিকের মৃত্যু
2021.04.22
ঢাকা
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে চীনা নাগরিকদের রক্ষায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন দুই বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ এস আলম এবং চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানায় নির্মাণাধীন ওই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে গত শনিবারের সহিংসতায় এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা হলো সাত।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে বুধবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদ শিমুল (২৩) ও মঙ্গলবার রাতে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে রাজেউল ইসলাম (২৫) নামে আহত ওই দুই শ্রমিক মারা যান।
এর মধ্যে রাজেউল ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা জানিয়েছেন বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল কবির।
“পাওয়ার প্লান্টে সে কোন কোম্পানির আওতায়, কী কাজ করত তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন তিনি।
তবে রাজেউলের মা ওয়াজেবুন নাহার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বেতদীঘি ইউনিয়নের নথন জামদানি গ্রাম থেকে মুঠোফোনে বেনারকে জানান, তাঁর ছেলে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রেই কর্মরত ছিল।
বকেয়া বেতন-ভাতা আদায় ও কর্মঘণ্টা কমানোর দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে “হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন নৃবিজ্ঞানী সাইদিয়া গুলরুখ কামাল।
“আমরা শুনেছি গ্রেপ্তারের ভয়ে আহত শ্রমিকেরা হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে সাহস পাচ্ছে না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “বাঁশখালীতে শ্রমিকদের ওপর চলছিল দৈনন্দিন নির্যাতন। সেখানে পানি ছিল না, বাথরুম ছিল না, নিয়মিত মজুরি দেয়া হতো না।
তিনি বলেন, “বিদেশি পুঁজির রক্ষায় সরকার শুধু পরিবেশ বিপন্ন করেনি, নিজ দেশের তরুণ নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করেছে।
উল্লেখ্য, ঘটনার দিনই বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবস্থানকারী চীনা নাগরিকদের সুরক্ষায় গুলি চালানোর কথা জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এই ঘটনার বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে বেনারের পক্ষ থেকে ঢাকার চীনা দূতাবাসে ই-মেইল পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
চীনের ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় কয়লাভিত্তিক এসএস পাওয়ার লিমিটেড নামের ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণের ঘটনায় ২০১৬ সালে পুলিশের গুলিতে চারজন ও ২০১৭ সালে পৃথক সংঘর্ষে আরো একজন নিহত হয়েছিলেন। এবার এখন পর্যন্ত মারা গেছেন সাতজন।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ এস আলমের ৭০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে এসএস পাওয়ারে। এ ছাড়া চীনের সেপকো থ্রি ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ২০ শতাংশ ও এইচটিজি ডেভলপমেন্ট গ্রুপের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলারের প্রকল্প। এর ৭০ শতাংশের বেশি ঋণ হিসেবে আসছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে।
প্রকল্পটিতে বর্তমানে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি ও প্রায় এক হাজার চীনা শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা।
হাইকোর্টে আসকের রিট
বকেয়া বেতন–ভাতাসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত ওই সাত শ্রমিক হত্যার বিচার চেয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আইনের আশ্রয় নেয়নি। তবে ঘটনাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছে মানবাধিকার ও আইন সহায়তা প্রদানকারী সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
এ ঘটনায় শ্রমিকদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলে জানান আসক মহাসচিব ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
তিনি বলেন, “রিটে বাঁশখালীর ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য তিন কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।”
আসকের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন সাংবাদিকদের জানান, রিটটি রোববার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে।
অন্যদিকে বাঁশখালী থানায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক ও স্থানীয়দের আসামি করে পুলিশ ও মালিক পক্ষের দায়ের দুই মামলায়ও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে বুধবার জানিয়েছেন ওসি শফিউল।
“মঙ্গলবার থেকেই পাওয়ার প্লান্টে পুনরায় কাজ শুরু করেছেন শ্রমিকরা,” বলেন তিনি।
ক্ষতিপূরণে সন্তোষ-অসন্তোষ
হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোহাম্মদ মোর্শেদ বেনারকে জানান, রবিবারই প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ সেখানে ভর্তি হওয়া আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দিয়ে গেছে, এই টাকা দিয়ে তাঁদের চিকিৎসার খরচ মেটাতে বলা হয়েছে।
“কিন্তু এখানে ইতিমধ্যে এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। আরো অনেকদিন হাসপাতালে থাকা লাগবে বলেও ডাক্তাররা জানিয়েছেন। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। আমার মতো সবার একই অবস্থা,” বলেন তিনি।
পাওয়ার প্লান্টের উত্তর পাশেই মোর্শেদের বাড়ি, চার মাস ধরে একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি তিন মাস কাজ করার পর বেতন পেয়েছেন। কারো কারো চার মাসের বেতনও বকেয়া ছিল বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী বেনারকে বলেছিলেন, যারা নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা করে এবং আহতদের নগদ ৫০ হাজার টাকার পাশাপাশি চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে।
নিহত শ্রমিক মো. রায়হানের (১৭) ভাই মো. রাফোল উদ্দিন রাহুল বেনারকে বলেন, ময়নাতদন্তের পর লাশ হস্তান্তরের সময় আমাদেরসহ আরো চারটি পরিবারকে নগদ তিন লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
“আমি এ নিয়ে আর কোনো মামলা-মোকদ্দমায় যেতে চাই না। যা হওয়ার হয়েছে, আল্লাহ এর বিচার করবে,” বলেন তিনি।
বাঁশখালীর ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কতজনকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা জানা নেই উল্লেখ করে এস আলম গ্রুপের মানব সম্পদ ও প্রশাসন প্রধান মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন বেনারকে বলেন, “বিষয়টি আসলে গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট না।”
“এসএস পাওয়ার ‘জয়েন্ট ভেঞ্চার’ প্রতিষ্ঠান, সম্পূর্ণ আলাদা প্রশাসন। শুধু তারাই বিদুৎকেন্দ্রটি দেখভাল করে। যে কারণে গ্রুপের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।
চীনা বিনিয়োগে সমস্যা হবে না
এর আগে ২০১৯ সালের জুনে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মাণাধীন পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাংলাদেশি ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে এক চীনা নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি না পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ অথবা অন্য খাতে চীনা বিনিয়োগে কোনো সমস্যা হবে।”
তিনি বলেন, “কলাপাড়া ও বাঁশখালী—উভয় স্থানে সমস্যার শুরু শ্রমিকদের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। তার মানে ঘটনা দুটি শ্রম সংক্রান্ত; এখানে বিনিয়োগের শর্ত ভঙ্গের কিছু নেই।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।