বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্পে হতাহতের তদন্ত প্রতিবেদন সবার জানা গুরুত্বপূর্ণ: আইএলও
2021.04.30
ঢাকা
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এস আলম এবং চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন বেসরকারি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে সাত শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জানিয়েছে, এ ঘটনায় তারা হতবাক ও শোকাহত।
বাংলাদেশে আইএলও’র কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন ই-মেইলে জানান, “এই ঘটনায় সরকারি তদন্ত চলছে এবং মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলো তদন্তে স্বাধীন ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
এসএস পাওয়ার লিমিটেড নামের ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে গত ১৭ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে পাঁচজন ও পরবর্তীতে আরো দুই গুলিবিদ্ধ শ্রমিক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এই সহিংসতার ঘটনা তদন্তের ফলাফল সবাইকে জানানো এবং তা নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ বলেও সোমবারের ওই ইমেইলবার্তায় জানান বাংলাদেশে আইএলও প্রধান।
এদিকে ওই সহিংসতার তদন্ত শেষ করতে আরো এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান পুলিশের গঠন করা কমিটির প্রধান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশন এন্ড ক্রাইম) মো. জাকির হোসেন খান।
ঘটনার সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদন দেবার কথা ছিল। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল তিনদিনের মধ্যে।
এ ব্যাপারে জানতে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার এবং জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমানের সাথে শুক্রবার একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঘটনার পর বাঁশখালী থানায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক ও স্থানীয়দের আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
সে বিষয়ে তদন্ত চলছে জানিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।”
অভিযোগগুলো সমাধানে নজর দেওয়ার দাবি আইএলওর
ঘটনার মূল কারণ উদঘাটনের তাগাদার পাশাপাশি কীভাবে এই জাতীয় কর্মস্থলে নজরদারি ও সামাজিক সংলাপ আরো জোরালো করা যায় সে সম্পর্কে পদক্ষেপের আহ্বান জানান আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো।
তিনি বলেন, বাঁশখালীর ঘটনাটি প্রত্যন্ত এলাকায় একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে, এমন সব কর্মস্থলে “সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে এনেছে।”
“কীভাবে কাজের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অভিযোগগুলো সমাধান করা হবে সেদিকে অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত,” বলেন তিনি।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে “সংলাপ হওয়া উচিত” বলে জানান তিনি।
‘সহিংসতার দায় চীন এড়াতে পারে না’
বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্পে সংঘঠিত হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার দায় চীন সরকার এড়াতে পারে না উল্লেখ করে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতকে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের ৮১ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
নির্মাণাধীন ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সাত শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় শুক্রবার ওই প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয় বলে জানানো হয় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
নিহত ও আহত শ্রমিকদের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি আক্রান্ত পরিবারগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে প্রতিবাদলিপিতে।
একইসঙ্গে চীনের আইন অনুসারে হতাহতের ঘটনা ও শ্রমিক হয়রানির জন্য দায়ী চীনা সংস্থাগুলোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ওই দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানান নাগরিকেরা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনা অংশীদারিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, “সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো ওই ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাতনামা শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে। এসএস পাওয়ার আই লিমিটেডের খপ্পর থেকে জীবন বাঁচাতে শ্রমিকরা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।”
শ্রমিকদের দাবিগুলো কোনোভাবে অবৈধ ছিল না উল্লেখ করে প্রতিবাদলিপিতে জানানো হয়, তাদের দাবির মধ্যে ছিল বকেয়া মজুরি প্রদান, প্রতিদিন দশ ঘণ্টা কাজ করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে রমজানে আট ঘণ্টা কাজ করা এবং শুক্রবার নামাজ পড়ার জন্য এক ঘণ্টা বিরতি দেওয়া।
“এগুলো শুধু দাবি নয়, বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে শ্রমিকদের অধিকার,” বলেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
এই প্রকল্পে “হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়” উল্লেখ করে তাঁরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নামে স্থানীয় পুলিশ এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীরা পৃথক ঘটনায় ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১২ জনকে হত্যা করেছে।
“এসব হত্যাকাণ্ড এবং সেখানকার সহিংসতার দায় চীন সরকার এড়াতে পারে না,” উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
ঘটনার দিনই বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবস্থানকারী চীনা নাগরিকদের সুরক্ষার স্বার্থেই গুলি চালানোর কথা বেনারকে বলেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে শ্রমিকেরা আবার প্রকল্পের কাজে যোগ দিয়েছে বলে জানান ডিআইজি জাকির হোসেন। শুক্রবার পর্যন্ত কমপক্ষে আড়াই হাজার শ্রমিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফিরে এসেছে বলে জানান বাঁশখালী থানার পরিদর্শক মো. আজিজুল ইসলাম।
প্রকল্প এলাকায় চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ রয়েছে বলেও জানান ডিআইজি জাকির।
এই ঘটনার বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে বেনারের পক্ষ থেকে ঢাকার চীনা দূতাবাসে ই-মেইল পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিশিষ্ট নাগরিকদের এই চিঠির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মেলেনি সরকারি সাহায্য
বাঁশখালীর সংঘর্ষে নিহত সাত শ্রমিকের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা এবং আহত ১৫ শ্রমিকের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেককে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান।
তবে এখন পর্যন্ত শ্রম মন্ত্রণালয়ের সহায়তা পাননি বলে বেনারকে জানান নিহত শ্রমিক আহমেদ রেজার মা নুরাইন জান্নাত। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তিন লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
বাঁশখালীতে এসএস পাওয়ার লিমিটেড নামের ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণের ঘটনায় ২০১৬ সালে পুলিশের গুলিতে চারজন ও ২০১৭ সালে পৃথক সংঘর্ষে আরো একজন নিহত হয়েছিলেন। এবার এখন পর্যন্ত মারা গেছেন সাতজন।
বাংলাদেশের শিল্পগ্রুপ এস আলমের ৭০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে এসএস পাওয়ারে। এ ছাড়া চীনের সেপকো থ্রি ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ২০ শতাংশ ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলারের প্রকল্প। এর ৭০ শতাংশের বেশি ঋণ হিসেবে আসছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে।
প্রকল্পটিতে বর্তমানে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি ও প্রায় এক হাজার চীনা শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা।