কর্ণফুলী নদীর টানেল: বিনা দরপত্রে টোল আদায়ের কাজ পেল চীনা কোম্পানি
2022.05.18
ঢাকা
বিনা দরপত্রে পদ্মা সেতুর পর এবার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের কাজ দেওয়া হলো একটি চীনা কোম্পানিকে।
বুধবার অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চায়না কমুনিকেশনস কন্সট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে কাজটি দেওয়া হয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সিসিসিসি বাংলাদেশে টোল আদায়ের কাজ পাওয়া দ্বিতীয় কোম্পানি। এর আগে গত মাসে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ও কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশনকে পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের কাজ দেয় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য “সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে” সিসিসিসি-কে নিয়োগে সেতু বিভাগের প্রস্তাব “নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে” বলে বুধবার বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিল্লুর রহমান চৌধুরী।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেতু বিভাগের সচিব মোঃ মনজুর হোসেন বুধবার বেনারকে বলেন, কর্ণফুলী টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের জন্য বিনা দরপত্রে সিসিসিসি-কে সুপারিশ করার কারণ হলো, “এই ধরনের প্রকল্প আমাদের দেশে এটাই প্রথম।”
“এটি পরিচালনা করার মতো যোগ্য দেশীয় কোম্পানি নেই। তারা এটা নির্মাণ করেছে। এই টানেলটি তারা ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে,” বলেন সচিব।
স্বচ্ছতার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়নি কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা চীনাদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বিনা দরপত্রে কাজ দেয়ার সুপারিশ করতে পারি।”
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় প্রস্তাবটি পাশ হলেও কত টাকায়, কীভাবে এবং কত বছরের জন্য তাদের কাজ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পুনরায় প্রস্তাবটি পাঠানো হবে বলে জানান সচিব মনজুর হোসেন।
বর্তমানে টানেলটির ৮০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময়সীমা রয়েছে। তবে টানেলটি কবে উদ্বোধন হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো পরিকল্পনা হয়নি।
সেতু বিভাগ থেকে কমিটির সভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো সংক্ষেপে বলা হয়েছে, এই কাজ দেওয়া হবে “পারফরম্যান্স বেইড” অর্থাৎ তাদের কাজের মানের ওপর নির্ভর করে। এই কাজ অনেক বড়ো এবং “জনস্বার্থে” এই কাজ চীনা কোম্পানিকে দেওয়া দরকার। বেনার প্রতিবেদক এই সারসংক্ষেপটি দেখেছেন।
চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের সড়ক, সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করলেও তারা টোল আদায় করে না। এ বছর এপ্রিল মাসে প্রথমবারের মতো আগামী জুন মাসে উদ্বোধন হতে যাওয়া পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের কাজ পায় চীন-কোরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কোম্পানি।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো দৈর্ঘ্যের যমুনা সেতুর টোল আদায় করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস (সিএনএস)। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিদেশি কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে কাজটি করার যোগ্যতা অর্জন করে।
কেন এই টানেল?
সীমান্তনদী কর্ণফুলী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। নদীর একপাশে চট্টগ্রাম সিটি ও চট্টগ্রাম বন্দর, নদীর অন্য পাশে বৃহৎ শিল্প কারখানা অবস্থিত।
দুই পাশে যোগাযোগের জন্য দুটি সেতু রয়েছে। এই সেতু অতিক্রম করে কক্সবাজার ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য অঞ্চলে যেতে হয়। সেতু দুটি পারাপারে অনেক সময় অপচয় হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগে সময় নষ্ট হয়। যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যানজট তৈরি হয়।
কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা সংকটের কথা চিন্তা করে নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণ থেকে সরে আসে সরকার। পরিবেশবাদী ও প্রকৌশলীদের মতে, নদীর ওপর পিলার সেতু নির্মাণ করলে নদীতে পলি জমাট হয়ে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গ সড়ক নির্মাণ করে নদীর দুই অংশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই টানেল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম সিটি বাইপাস করে যানবাহন কর্ণফুলী নদীর এপার থেকে ওপারে চলাচল করতে পারবে।
২০১৩ সালে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে সেটি বাস্তবায়নযোগ্য বলে জানায় চায়না কমুনিকেশন কন্সট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) এবং ওভে অরুপ অ্যান্ড হংকং লিমিটেড।
সড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত এ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়, দুইমুখী টানেলসহ নয় কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সড়কের মোট খরচ হবে প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার সড়কের জন্য খরচ ধরা হয় ৭৪ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার।
এই প্রকল্পে চীনা এক্সিম ব্যাংক অর্থায়নে রাজি হয়।
২০১৫ সালের ৩০ জুন সরকারের সড়ক বিভাগ ও সিসিসিসি এর সাথে ৭০৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে সেই প্রকল্পের খরচ এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এই টানেলের কাজ শুরু হয়। তবে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এই প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকল্পটি ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বর্তমানে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।