আন্তর্জাতিক রূপ পাবে কক্সবাজার বিমানবন্দর

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2021.08.30
ঢাকা ও কক্সবাজার
আন্তর্জাতিক রূপ পাবে কক্সবাজার বিমানবন্দর অবতরণের পর কক্সবাজার বিমানবন্দরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা। ২৮ এপ্রিল ২০১৮।
[রয়টার্স]

সাগর থেকে ভূমি উদ্ধার করে সবচেয়ে বড়ো রানওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে কক্সবাজার অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরকে দেশের সর্বাধুনিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রোববার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সোমবার বেনারকে জানিয়েছেন, দেশে প্রথমবারের মতো সাগরের মধ্য থেকে ভূমি উদ্ধার করে এই মেরিন বিমানবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কাজে ব্যয় হবে এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা যা ১৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। 

তিনি বলেন, চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন করপোরেশন এবং চ্যাংজিয়াং ইচ্যাং ওয়াটারওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো নামে দুটি চীনা কোম্পানি মাধ্যমে ২০২৪ সালের আগেই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে। 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “কক্সবাজার বিমানবন্দরের বর্তমান নয় হাজার ফুট রানওয়েকে দশ হাজার ৭০০ ফুটে রূপান্তরিত করা হবে। এটি করা গেলে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে দেশের সকল বিমানবন্দরের চেয়ে বড়ো হবে এবং বড়ো বিমান এখানে নামতে পারবে।”

“কক্সবাজার বিমানবন্দরের বাকি জমি সাগর থেকে উদ্ধার করা হবে। এটিই দেশের প্রথম মেরিন এয়ারপোর্ট,” বলেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এই প্রকল্প ২০২৪ সালের মে মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। তবে আমরা এই প্রকল্পটি ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করতে বলেছি।” 

এই প্রকল্প শেষ হলে সব ধরনের বড়ো উড়োজাহাজ কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারবে, রিফুয়েলিং করতে পারবে এবং তা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলেও জানান মাহবুব আলী।

কক্সবাজার বিমানবন্দর বিদেশি বিমান সংস্থার জন্য আকর্ষণীয় করতে রিফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বিমানবাহিনীর 'সক্ষমতাও বাড়বে'

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে স্থাপন করা হয় কক্সবাজার অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। বর্তমানে এই বিমানবন্দরের আয়তন ৯৪১ একর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে এই বিমানবন্দর বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেরামতের পর পুনরায় চালু হয় বিমানবন্দরটি।

পুরো বিমানবন্দরে অবকাঠামো নেই বললেই চলে। রয়েছে একটি ছোট ভবন যেখান থেকে সকল কাজ পরিচালনা করা হয়। বিমান থেকে যাত্রী নামার পর মালামাল রাখা হয় রানওয়েতে।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট শুরু হলে এই বিমানবন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যায়। সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটতে থাকে।

এই বছর ৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করতে চীনা ওই দুই কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

তবে এই বিমানবন্দরের কাজ চীনা কোম্পানিকে দেয়ার কারণে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা শুরু হয়। বলা হয় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

তবে সরকার বলছে, চীনা কোম্পানি দরপত্র দাখিল করে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজটি পেয়েছে।

ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ফেসবুক পেজে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশই প্রথম চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগে যোগ দিয়েছে।

তিনি বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি চীন-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং মহামারির মধ্যেও এই প্রকল্প কক্সবাজার জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকা হতে ভূমিকা রাখবে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বেনারকে জানান, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী বিমানগুলো কক্সবাজার বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে চলাচল করে।

তিনি বলেন, “এই সুবিধাজনক অবস্থানকে মাথায় রেখে আমি যখন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী ছিলাম তখন কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার প্রস্তাব করি, যাতে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলে চলাচলকারী বিমানগুলো এখানে রিফুয়েলিং (জ্বালানী) করতে পারে।”

ফারুক খান বলেন, “আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত হলে সমুদ্রসৈকত হিসাবে কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়বে।”

তিনি বলেন, শুধু অর্থনৈতিক নয়, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করা গেলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সামরিক সক্ষমতা বাড়বে। এই বিমানবন্দর থেকে প্রয়োজনে সামরিক বিমানও ওঠানামা করতে পারবে। 

বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিমানগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং যশোর থেকে ওঠানামা করতে পারে। সামরিক কৌশলবিদদের মতে মিয়ানমার সীমান্তে কক্সবাজার জেলায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশকে অনেক সুবিধা দেবে।

কক্সবাজার সুশীল সমাজের নেতা আবু তাহের চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত হলে কক্সবাজারের চেহারাই পাল্টে যাবে।

তিনি বলেন, "এখন ঢাকা হয়ে ঘুরে বিদেশি পর্যটকদের কক্সবাজার আসতে হয়। এটি আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমান সরাসরি কক্সবাজারে অবতরণ করবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটন এবং অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।" 

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের প্রায় এক হাজার ৭০০ ফুট ভরাট করে রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সমুদ্রের পানি ছুঁয়ে কক্সবাজারে বিমান অবতরণ করবে, এটিও পর্যটকদের জন্য একটি অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা।

“অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তো আছেই; পাশাপাশি এই বিমানবন্দরের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী আবার নতুন সম্ভাবনার দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে চিনবে,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।