ঢাকায় গার্ডার পড়ে পাঁচ ব্যক্তি নিহত হলেও শাস্তি ছাড়াই কাজ শুরুর অনুমতি পেয়েছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান
2022.09.26
ঢাকা
চীনের যে ঠিকাদার কোম্পানির অবহেলার কারণে ঢাকার উত্তরায় গার্ডার পড়ে দুই শিশুসহ পাঁচ ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন, সেই কোম্পানিকে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ আবার শুরু করার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। অথচ চুক্তি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা, তদন্তেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অবহেলা থাকার প্রমাণ মিলেছিল।
সড়ক পরিবহন ও সেতু সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বেনারকে বলেন, “ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প এলাকায় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করায় চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানিকে পুনরায় কাজ শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমরা চাই তারা যত তাড়াতাড়ি পারে কাজটি শেষ করুক।”
তিনি বলেন, “প্রকল্পটি মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছে। এখন এটি দ্রুত শেষ করতে হবে। কতদিন আর এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়া যাবে?”
চুক্তি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে পুনরায় কাজ শুরু করতে দেয়া হলো কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব নুরী বলেন, “হ্যাঁ, সরকারি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, তারা সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। সরকার যদি ব্যবস্থা না নেয়, সেক্ষেত্রে আদালত ব্যবস্থা নেবে।”
“প্রকল্পটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ঠিকাদার এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এডিবির সম্মতি প্রয়োজন। আমরা তাদের সাথে এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছি,” বলেন সচিব।
এদিকে প্রকল্পটির মেয়াদ চতুর্থবারের মতো বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান বাস্তবায়নকারী সরকারি ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি ঠিকাদার কোম্পানি চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানির বিরুদ্ধে চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্মতি প্রয়োজন।
তবে চুক্তি অনুযায়ী, সুরক্ষাসহ অন্যান্য শর্ত ভঙ্গের জন্য চীনা কোম্পানির সাথে চুক্তি বাতিল এবং তাদের কলোতালিকাভুক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে।
বেনারের পক্ষ থেকে মন্তব্যের জন্য এডিবির ঢাকাস্থ কার্যালয়ে সাথে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র কথা বলতে রাজি হননি। একইভাবে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
‘চলমান প্রকল্পের ঠিকাদার পরিবর্তন কঠিন’
যানজট কমিয়ে রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ সহজ করতে ২০১৬ সালে গাজীপুর থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ২০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পায় চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি। প্রকল্পটির বর্তমান ব্যয় চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তিন দফা সময় বৃদ্ধি করা হলেও ২০২১ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি কোম্পানিটি।
ঢাকা বাস র্যাপিড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি বিআরটি প্রকল্পের একটি অংশ যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়া যাবে।”
তিনি বলেন, “প্রকল্পের ভৌত কাজের প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আশা করা যায় আগামী বছর মার্চ মাসের মধ্যে শেষ হবে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত লাগতে পারে। আমরা ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছি।”
শফিকুল ইসলাম বলেন, “একটি চলমান প্রকল্পের ঠিকাদার পরিবর্তন করা কঠিন। গার্ডার পড়ার ঘটনায়, ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেবে তারা (কোম্পানি)।”
চুক্তি বাতিল করা কিংবা তাদের কালো তালিকাভুক্ত করার বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল ইসলাম বলেন, “চুক্তিতে অনেক কথাই তো বলা থাকে। সেগুলো কিছু কিছু বাস্তবায়ন করা বাস্তবসম্মত নয়।”
সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এ.কে.এম. মনির হোসেন পাঠান বেনারকে বলেন, “চায়না গেজুবা একটি বিদেশি কোম্পানি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সহজ নয়।”
পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ. মান্নান সোমবার বেনারকে বলেন, বিআরটি প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে আসলে সেটি পাশের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, প্রকল্পের কাজ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া একইসাথে চলা উচিত। কাজটি প্রথমে শেষ করা উচিত।”
টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব
উল্লেখ্য, চায়না গেজুবা কোম্পানি বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে যেখানে কাজ হয় সেখানে চলাচল বন্ধ অথবা সীমিত করা হয়। অথবা রাতে যখন জনসমাগম থাকে না, তখন কাজ করা হয়।
কিন্তু চীনা এই কোম্পানিকে বার বার সতর্ক করা হলেও তারা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়নি বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গত ১৫ আগস্ট দুর্ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে সরকার।
গত ১৫ আগস্ট বিকালে ভারি একটি গার্ডার একটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে যায়। ওই গাড়িতে নব বিবাহিত দম্পতি ও দুই শিশুসহ সাত ব্যক্তি ছিলেন। বর ও কনে ছাড়া সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যান।
গত বছর মার্চে উত্তরা এলাকায় ওই প্রকল্পের গার্ডার ধ্বসে পড়ে চীনা নাগরিকসহ ছয় ব্যক্তি আহত হন। এবছর গাজীপুরে একই প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান এক বাংলাদেশি শ্রমিক। এরপরও কোম্পানিটি তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করেনি।
উত্তরায় ১৫ আগস্ট গার্ডার পড়ে পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যুর ব্যাপারে উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা মামলার বাদী মো. আফরান মন্ডল বাবু বেনারকে বলেন, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে চায়না গেজুবা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কমপক্ষে তিন কর্মকর্তা তাদের আশুলিয়ার বাসায় যান। কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।
বাবু জানান, “তবে আমরা এই প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমরা তাদের কাছে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছি। তারা এতে রাজি হয়নি।”
তিনি জানান, মামলা দায়েরের পর পুলিশ ওই কোম্পানির ১০ স্থানীয় নাগরিকদের আটক করে, তাঁরা জামিনে আছেন। তবে ওই ঘটনায় কোনো চীনা নাগরিককে আটক করা হয়নি বলে তিনি জানান।