কালো তালিকাভুক্ত এক চীনা ব্যবসায়ী দশ দিন ধরে অবস্থান করছেন বিমানবন্দরে
2021.11.19
ঢাকা
বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় গত দশ দিন ধরে এক চীনা ব্যবসায়ী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন। ঢাকায় তার স্ত্রী থাকায় তাঁকে ছাড়া ফিরেও যেতে চাচ্ছেন না তিনি।
বেসরকারি বিনিয়োগকারী হিসেবে পিআই (পারসোনাল ইনভেস্টর) ভিসা নিয়ে গত ১০ নভেম্বর ঢাকায় আসেন ঝোউ ইয়া (৪৮)। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁকে বিমানবন্দর পার হতে দেয়নি অভিবাসন পুলিশ।
“বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মকর্তারা বলছেন, আমি ঢুকতে পারব না। আমাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে,” শুক্রবার মুঠোফোনে বেনারকে বলেন ঝোউ ইয়া।
“আমি এখানে ১০ দিন কাটিয়ে দিয়েছি। আরো কতদিন থাকতে হবে আমি জানি না,” বলেন তিনি।
ঢাকায় তাঁর বাসা ও ব্যবসা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার স্ত্রীকে এভাবে ফেলে রেখে আমি চলে যেতে পারি না। তাছাড়া সে-ও এখান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।”
চীনা এই নাগরিক গত দশদিন ধরে “লাউঞ্জেই শুয়ে-বসে থাকেন, সেখানেই ঘুমান,” বলে বেনারকে জানান বিমানবন্দরের মুজিব কর্নার লাউঞ্জের কর্মচারী শাকিল ইসলাম।
সরকারি একটি প্রকল্পের কাজে বাংলাদেশে এসে অন্য কাজে জড়িত হওয়ার দায়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর ঝোউকে কালো তালিকাভুক্ত করে তাঁর বাংলাদেশ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট) মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমি যতদূর জানি বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। সাতদিনের মাথায় তাঁর ফ্লাইট ছিল। তিনি দশদিন ধরে বিমানবন্দরে থাকবেন কেন?”
“লোকটা ইচ্ছে করে রয়ে গেছে। আমাদের অফিসারদের সাথে দেখাই করেনি বা তাদের এড়িয়ে গেছে। এখানে বসে বিভিন্নভাবে ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তার ধারণা, ঝোউ ইয়া অসুস্থ হওয়ার চেষ্টা করছেন, যাতে তাঁকে বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, এর আগে এমন অনেক ‘প্রতারক’ অসুস্থ সেজে প্রবেশ করে গভীর রাতে হাসপাতাল থেকে পালানোর চেষ্টাও করেছে।
“এদের নিয়ে খুবই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের । যে কারণে কালো তালিকাভুক্ত-এমন কাউকে আর ছাড় দেওয়া হবে না,” বলেন ডিআইজি মনিরুল।
গোপনে ব্যবসা পরিচালনার দায়ে নিষিদ্ধ
বেনারের হাতে থাকা ঝোউ ইয়ার একাধিক নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তিনি প্রথমে ‘এ-থ্রি’ শ্রেণির ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন, যা মূলত সরকারের সাথে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত দ্বি-পাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তির আওতাধীন প্রকল্পে নিয়োজিতদের জন্য দেওয়া হয়।
এর পরে গত ২৩ আগস্ট তাঁর ভিসার ধরন বদলানোর আবেদন মঞ্জুর করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। একইসঙ্গে তাঁর স্ত্রী টু শিং রং–এর ভিসার ধরন বদলানোর ব্যাপারেও সম্মতি দেওয়া হয়। চীনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তাঁকে নতুন পিআই শ্রেণির ভিসা দেয়া হয় গত গত ৬ সেপ্টেম্বর।
কিন্তু এর দুসপ্তাহ পরেই, ২২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন শাখা তাঁদের বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
নথিতে ঝোউ ইয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, তিনি সরকারি প্রকল্পে এসে অন্য কাজে জড়িত হয়েছেন এবং অবৈধভাবে গোপনে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। দ্বিতীয় অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধেও।
কোনো ভিসা প্রার্থীকে প্রকৃত বিনিয়োগকারী হিসেবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) প্রত্যয়ন দিলে সংশ্লিষ্ট ভিসা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বহুভ্রমণ সুবিধাসহ সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য পিআই ভিসা দিতে পারে।
গত ৭ জুন বিডার কাছ থেকে এই প্রত্যয়ন পেয়েছে ঝোউ ইয়ার প্রতিষ্ঠান চুন ইউ হাই লিমিটেড, যেখানে তাঁকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর স্ত্রী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে যে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন, সেখানে ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কথা উল্লেখ করে এই কোম্পানির ব্যবসার ধরন হিসেবে লেখা হয়েছে ‘ট্রাভেল এজেন্ট’।
গত ৩১ মার্চ এই লাইলেন্সটি ইস্যু করেছে ডিএনসিসি।
অভিবাসন পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, অনেক দেশের নাগরিকই বাংলাদেশের পিআই ভিসার অপব্যবহার করে। তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার ব্যাংকে রেখে এই ভিসা নেয়।
ওই টাকা বিনিয়োগ করে এখানে কর্মসংস্থান তৈরি করার কথা থাকলেও সেটা তারা করে না। বরং বিনাশুল্কে নিজের দেশের মালামাল বা পণ্য এনে এখান থেকে অধিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে।
তবে ঝোউ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে আমি কখনো বেআইনি ব্যবসা করিনি। আমি কিছু শাকসবজি এবং খাবার বাংলাদেশে অবস্থানরত চীনাদের কাছে বিক্রি করেছি।”
দশ দিন ধরে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে আটকে থাকার ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি না জানা নেই মন্তব্য করে চীনে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “তিনি হয়তো আশা করছেন, এটার সমাধান করতে পারবেন। যে কারণে যাচ্ছেন না।”
অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- চায়না অ্যালামনাইয়ের (অ্যাবকা) সভাপতি ফয়েজের মতে, “এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো” কোনো বিষয় নয়। কারণ তেমন কিছু হলে দুই দেশের সরকারের মধ্যে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ হতো।
তবে ঝোউ ইয়ার ব্যাপারে জানতে চেয়ে শুক্রবার ঢাকার চীন দূতাবাসকে ই-মেইল পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।