পদ্মা সেতু: আবারও বাড়ল খরচ ও সময়
2023.04.18
ঢাকা
আবার বাড়ানো হলো পদ্মা নদীর ওপর বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বহুল আলোচিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের খরচ। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই সেতুর খরচ বাড়ল প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, বাস্তবায়নের সময় বেড়েছে এক বছরের কিছু বেশি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ এবং খরচ বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয় বলে সাংবাদিকদের জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ. মান্নান।
এর ফলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সড়ক অংশের খরচ বেড়ে দাঁড়ালো ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বেশি। সেতুর সম্পূর্ণ কাজ ২০২৩ সালের জুনের পরিবর্তে শেষ হবে ২০২৪ সালের জুন মাসে। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সময় লাগছে ১৫ বছর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে বার বার সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধি সরকারের পূর্ব ঘোষণার সাথে সাংঘর্ষিক এবং এটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার অভাব।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সভা শেষে বেনারকে বলেন, “পদ্মা সেতুর সড়ক অংশ চালু হলেও প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু বাড়তি কাজ করেছেন ঠিকাদার ও পরামর্শক। এই ধরনের বড়ো প্রকল্প বিশ্বে পাঁচ-ছয়টি বাস্তবায়িত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সেকারণে বাড়তি খরচের প্রস্তাব করা হয় এবং খরচ ও সময় বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়েছে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বেনারকে বলেন, “পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে প্রকল্পের পরিচালকসহ সবাই বলেছিলেন যে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নকাল এবং খরচ কোনোটিই আর বৃদ্ধি করা হবে না; বরং সেটি কমবে। আজকে ব্যয় এবং বাস্তবায়নকাল বৃদ্ধি সরকারের সেই সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক।”
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতুর খরচ এবং বাস্তবায়নকাল বার বার বৃদ্ধির কারণে প্রমাণ হয় যে ঠিকাদার এবং পরামর্শকদের জবাবদিহি করার ক্ষমতা সরকারি পরামর্শকদের নেই বা খুবই কম।”
অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, “জাতীয় পরামর্শকদের দায়িত্ব হলো, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনের আলোকে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে কি না। যদি না হয় সেটি পরামর্শকদের বের করতে হবে এবং প্রকল্পটির দাবিকৃত বাড়তি খরচগুলো কতটুকু যথার্থ সেব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো দেখা যায় না।”
তিনি বলেন, “আমরা সবকিছুই রেকর্ড খরচে বাস্তবায়ন করি। হয়তো এটিও একটি রেকর্ড হবে।”
কেন এই ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি?
পদ্মা সেতু প্রকল্পের চতুর্থ ব্যয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত কাগজপত্র বেনারের হাতে এসেছে।
প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের জন্য ঠিকাদারদের দাখিল করা বেশ কিছু দাবি এখনও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। সেকারণে সম্ভাব্য ব্যয় মেটাতে অর্থের সংস্থান রাখা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বৈদেশিক ঠিকাদারের চুক্তির ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর এবং আয়কর ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্যমান ৭৮ দশমিক ৩০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১০৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সেকারণেও ব্যয় বৃদ্ধি প্রয়োজন।
এছাড়াও সেতুর ডিজাইন পরিবর্তনের জন্যও খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
পরিবর্তনের অংশে বলা হয়েছে, সেতুর ৪১টি পিয়ারের মধ্যে ২২টি পিয়ারের স্থলে নরম মাটির স্তরের অবস্থান থাকায় ওই সব পিয়ারের পাইল পুনঃডিজাইন করতে হয়। পরিবর্তিত ডিজাইন অনুযায়ী, ২২টি পিয়ারে ছয়টির পরিবর্তে সাতটি করে পাইল নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মাইক্রোফাইন সিমেন্ট ব্যবহারের কারণে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সেতুর মাওয়া প্রান্তে নদীর গভীরে সৃষ্ট গর্ত ভরাট করতে হয়েছে। ২০১৫, ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে প্রবল বন্যা ও তীব্র স্রোতের ফলে নদীশাসন কাজের ডিজাইন লেভেল থেকে আরও নিচে কিছু বড়ো আকারের গর্ত সৃষ্টি হয়। এই গর্তগুলো প্লাস্টিক ব্যাগ অথবা জিও ব্যাগ দিয়ে ভরাট করতে হয়েছে। সেকারণে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
এ ছাড়াও, বিভিন্ন সম্পূরক অবকাঠামো নির্মাণ এবং বৃদ্ধি করতে অতিরিক্ত অর্থের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর পিয়ার পুনঃডিজাইন ও অতিরিক্ত পাইল সংযোজনের ক্ষেত্রে সেতুর কোনো ঝুঁকি রয়েছে কি না সে সম্পর্কে বেনারের প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই বাড়তি কাজ করতে হয়, বাড়তি অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়।
এটিকে একটি “সাধারণ প্রক্রিয়া” হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই ধরনের খরচ অন্তর্ভুক্ত করতে দরপত্রে শর্ত দেয়া থাকে। কিন্তু বাড়তি কাজগুলো যৌক্তিক কি না সেটি দেখার দায়িত্ব সরকারের।”
পদ্মা সেতুর সংশোধনী ও ব্যয় বৃদ্ধি
রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে সরাসরি সড়ক ও রেলপথে যুক্ত করতে পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের। সেই আলোকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি সরকার প্রকল্পের স্থান নির্বাচনসহ প্রাথমিক কাজ করে।
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট একনেক বৈঠকে প্রায় ২০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় সংবলিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ধরা হয় ২০০৭ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস। তবে তারা কাজ শুরু করতে পারেনি।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর ২০১১ সালের ১৬ জুন প্রকল্পটি প্রথম সংশোধন করে আওয়ামী লীগ সরকার। বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৫ এবং খরচ ধরা হয় ১০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকার বেশি।
২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একনেক বৈঠকে প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বৃদ্ধি করে বাস্তবায়ন কাল ধরা হয় ডিসেম্বর ২০১৮ এবং খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার বেশি।
২০১৮ সালের ২১ জুন একনেক বৈঠকে প্রকল্পের ‘বিশেষ সংশোধনী’ নামে তৃতীয় সংশোধনী অনুমোদন দেয়া হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য এক হাজার চার’শ কোটি টাকা বাড়তি সংযোজন করায় প্রকল্পের মূল খরচ দাঁড়ায় ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৩ সালের জুন মাসে।
আজ ১৮ এপ্রিল প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করে নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন। এ ছাড়া দুই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ বৃদ্ধি করায় পদ্মা সেতু তৈরিতে খরচ হবে মোট ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বেশি।
ঘটনাবহুল পদ্মা সেতু
রাজনৈতিকভাবে খুব আলোচিত এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম সফলতা বলে মনে করা হয়।
শুরু থেকেই দাতা গোষ্ঠীর অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের কথা ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে রাজি হয়।
তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমানসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি করার চক্রান্ত সংক্রান্ত অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক।
এই ঘটনায় আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব হারান। তবে পরে কানাডার আদালত ঘোষণা করে যে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির চক্রান্ত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন এবং চীনা ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে এই প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করেন।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু প্রকল্পের সড়ক সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা নদীর ওপর বৃহত্তর ঢাকার মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া এবং মাদারীপুর জেলার জাজিরাকে সংযুক্তকারী ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি দুই তলা। নিচ তলায় রয়েছে রেল লাইন এবং ওপর তলায় সড়ক সেতু।
পদ্মা রেল সংযোগ সেতুর জন্য অর্থায়ন করছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার বেশি। এ বছর সেপ্টেম্বর থেকে সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরু হবে বলে জানিয়েছে সরকার।