পাইপলাইন নির্মাণ না করেই চীনা ঋণে তৈরি পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.07.13
ঢাকা
পাইপলাইন নির্মাণ না করেই চীনা ঋণে তৈরি পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধন ঢাকার আফতাবনগরসংলগ্ন দাসেরকান্দিতে ঢাকা ওয়াসার তৈরি দেশের বৃহত্তম পয়ঃশোধনাগার। ১৩ জুলাই ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

তরল বর্জ্য সংগ্রহের জন‌্য প্রয়োজনীয় পাইপলাইন নির্মাণ না করেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি (এসটিপি) কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছে।

বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর আফতাবনগরের কাছে অবস্থিত ঢাকা ওয়াসার এই পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধন করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসার ব‌্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ. খান বলেন, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ আশেপাশের এলাকায় দৈনিক উৎপাদিত তরল বর্জ‌্যের মধ‌্যে ৫০ কোটি লিটার দাসেরকান্দিতে পরিশোধন করা হবে। ফলে ঢাকার পরিবেশ দূষণ কমবে।

এদিকে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দাসেরকান্দি প্রকল্পটি এখনই ঢাকার মানুষের কোনো কাজে আসবে না। কারণ গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ প্রকল্প এলাকায় তরল বর্জ্য সংগ্রহের পাইপলাইন না থাকায় তরল বর্জ্য শোধনাগারে নেওয়া যাবে না।

তাঁদের মতে, এটি অনেকটা রাস্তা নির্মাণ ছাড়াই সেতু নির্মাণের মতো ঘটনা।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ আশেপাশের এলাকায় সুয়ার নেটওয়ার্ক নেই। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা পয়ঃপরিবহনের জন‌্য পাইপলাইন নির্মাণ করবে।”

“ওইসব এলাকায় পয়ঃব‌্যবস্থাপনার জন‌্য বাড়ি নির্মাণের সময় সেপটিক ট‌্যাংক স্থাপন করা হয়েছে কি না সেটি দেখে আমরা নকশা অনুমোদন করি,” বলেন তিনি।

সেপটিক ট‌্যাংক থেকে পয়ঃবর্জ‌্য কোথায় যায় এমন প্রশ্নের জবাবে উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, “সেগুলো সেপটিক ট‌্যাংকেই থাকে। তবে পানির মতো তরল হয়ে গেলে সেটি খালে নর্দমায় চলে যায়। আসলে আমরা এ ব‌্যাপারে এতো সচেতন নই।”

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “১৪ বছর আগে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওয়াসাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ঢাকার সমস্ত পয়ঃবর্জ‌্য সরাসরি নদী, খালে, নর্দমায় না ফেলে সেগুলো পরিশোধন করে নদীতে ফেলার ব‌্যবস্থা করবে। ফলে ঢাকার খাল-নদীগুলো দূষণমুক্ত থাকবে।”

“সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দাসেরকান্দিসহ মোট ৫টি পয়ঃশোধনাগার স্থাপনের কথা ঘোষণা করে ঢাকা ওয়াসা। ১৪ বছর পরে মাত্র একটি নতুন পয়ঃশোধনাগার স্থাপন করেছে ওয়াসা। যা জনগণের কোনো কাজে আসবে না,” বলেন তিনি।

“দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু যে এলাকাগুলোর জন‌্য এই পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প সেই এলাকায় পয়ঃ সংগ্রহের জন‌্য পাইপলাইন নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা হয়নি। রাস্তা নির্মাণ না করে সেতু নির্মাণ করলে যে অবস্থা এই প্রকল্পের অবস্থা তেমনই। সুতরাং, এটিকে বসিয়ে রাখতে হবে। কোনো কাজে আসবে না,” বলেন ইকবাল হাবিব

ঠিক হয়নি

প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের নগর ঢাকার পানি সরবরাহ এবং পয়ঃবর্জ‌্য ব‌্যবস্থাপনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনার জন‌্য বর্জ্য শোধনাগার থাকার কথা থাকলেও ওয়াসা সেই কাজ করতে পারেনি। পুরো ঢাকার পয়ঃবর্জ‌্যসহ অন‌্যান‌্য তরল বর্জ্য ব‌্যবস্থাপনার জন‌্য নারায়ণগঞ্জের পাগলায় একটিমাত্র শোধনাগার আছে।

ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন ২০০ কোটি লিটার তরল বর্জ্য উৎপাদন হয়। যার মধ‌্যে রয়েছে টয়লেটের পানি, বৃষ্টির পানিসহ অন‌্যান‌্য তরল বর্জ্য। নারায়ণগঞ্জের পাগলায় ২০ কোটি লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা যায়।

ঢাকার অধিকাংশ এলাকার পয়ঃবর্জ‌্য কোনো প্রকার শোধন ছাড়াই সরাসরি নদী-নালা, খাল ও জলাশয়ে ফেলা দেওয়া হয়। ফলে ঢাকার অন‌্যতম বালু নদী মরে গেছে। এই নদী দেশের বাণিজ‌্য পথের অন‌্যতম শীতলক্ষ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিশোধন করে বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা।

একইভাবে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী। এই সমস‌্যা সমাধানে পয়ঃশোধনাগার স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা।

দাসেরকান্দি প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াসার ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত কাগজপত্র থেকে জানা যায়, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, ডিওএইচএস, তেজগাঁও, মগবাজার, ইস্কাটন, নিকেতন, কলাবাগান (আংশিক) এবং হাতিরঝিল ও আশেপাশের এলাকার সৃষ্ট পয়ঃবর্জ‌্য পরিশোধন করে বালু নদীতে নিষ্কাশন এবং এর মাধ‌্যমে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ করা।

এছাড়াও, সায়েদাবাদ শোধানাগার ফেস-১ এবং ফেস-২ এর জন‌্য শীতলক্ষ্যা নদীর যে অংশ থেকে পানি নেওয়া হয় সেখানকার দূষণ কমানো।

প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ঢাকা মহানগরীর সব পয়ঃবর্জ‌্য আবাসিক ও বাণিজ‌্যিক এলাকা থেকে পাইপলাইনের মাধ‌্যমে মলমূত্র মিশ্রিত পানি শোধনাগারে নেওয়া হবে।

সেখান থেকে মলসহ কঠিন বর্জ্য আলাদা করে তরল বর্জ্য বিশুদ্ধ করে বালু নদীতে ফেলে দেওয়া যাবে এবং কঠিন বর্জ্য শুকিয়ে পরিবেশসম্মতভাবে কাজে লাগানো হবে।

ওয়াসার প্রকল্প দলিল অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প গ্রহণ করে এবং চীনা এক্সিম ব‌্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখনকার পরিকল্পনামতো প্রকল্পটি শেষ হবার কথা ছিল ২০২২ এর জুলাইতে।

মোট খরচ ধরা হয় তিন হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। যার মধ‌্যে দুই হাজার ১৮৪ কোটি টাকা চীনের কাছ থেকে ঋণ হিসাবে পাওয়ার কথা।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুই বার সংশোধন করে প্রকল্প ব‌্যয় তিন হাজার ৪৮২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ‌্যে চীনা ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৩৬৬ কোটি টাকায়।

পাইপলাইনের বিকল্প হিসেবে মহানগরীর হাতিরঝিলের তরল বর্জ্য পরিশোধন করে এটি চালু রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়াসার কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম‌্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “হাতিরঝিলের পানি শোধন করার জন‌্য তো দাসেরকান্দি প্রকল্প করা হয়নি! এটি করা হয়েছে গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ আশেপাশের এলাকার পয়ঃশোধন করার জন‌্য।”

তিনি বলেন, “ওয়াসা যা করেছে তা আসলে ঠিক হয়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।