রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: গোপনে বাংলাদেশ ও চীনের দুই কর্মকর্তার সফর বিনিময়

আহম্মদ ফয়েজ
2023.04.19
ঢাকা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: গোপনে বাংলাদেশ ও চীনের দুই কর্মকর্তার সফর বিনিময় কক্সবাজার টেকনাফের একটি শরণার্থী শিবিরে নিজের ঘরের সামনে এক রোহিঙ্গা দম্পতি। সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিনিধিদলকে প্রত্যাবাসন বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁরা। ২৮ মার্চ ২০২৩।
[আব্দুর রহমান/বেনারনিউজ]

নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে চীন। মিয়ানমারের মিত্রদেশ বলে পরিচিত চীনের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রবলভাবে আগ্রহী বাংলাদেশও।

“চীনের একজন দূত ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পরে আমাদের একজন সচিব (পররাষ্ট্র সচিব) বেইজিং গেছেন। এই সফরগুলোর উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন,” বুধবার বেনারকে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।

তবে এই বিষয়ে শুরু থেকেই কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করছে ঢাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলছেন না চীনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে।

“প্রত্যাবাসন ইস্যুটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনো ডায়ালগ হচ্ছে না, সেজন্য আমরা বিষয়টা নিয়ে খুবই সিরিয়াস, আমরা এর সমাধান চাই,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই জন কর্মকর্তা বেনারকে নিশ্চিত করেছেন, চলতি মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সফর করেছেন চীনের বিশেষ দূত দেং শিজুন।

ওই কর্মকর্তারা বলেন, চীনা দূতের সফরের সময় জরুরি ভিত্তিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল ঢাকায় চীনের দূতাবাস, দূতাবাসের অনুরোধেই বৈঠকের বিষয়টি গোপন রাখা হয়।

তাঁরা জানান, শিজুনের বৈঠকের পর ঢাকা থেকে অনেকটা গোপনেই বেইজিংয়ে পাঠানো হয় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনকে।

“পররাষ্ট্র সচিব এবং চীনা দূতের একই এজেন্ডা,” উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ আশা করে রোহিঙ্গারা “মর্যাদার সঙ্গে তাদের দেশে ফিরে যাবে। এ বিষয়ে চীন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসাযোগ্য।”

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে অনেকেই কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে চীন “খুব ভালো” একটি উদ্যোগ নিয়েছে এবং তারা সেই অনুযায়ী কাজ করছে।

তবে প্রত্যাবাসন কবে শুরু হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা কঠিন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য অতীতে দু’বার চেষ্টা করা হলেও সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।”

চীনা দূতের ঢাকা সফরের সময় কেন কঠোর গোপনীয়তা পালন করতে হয়েছে এবং ওই বৈঠকের অফিসিয়াল এজেন্ডা কী ছিল তা জানতে চেয়ে ঢাকায় চীনের দূতাবাসে ই-মেইল পাঠিয়েও কোনো জবাব পায়নি বেনার।

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা সফরের আগে চীনের দূত মিয়ানমারে ঘুরে এসেছেন। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন তিনি।

চীনের দূতের ঢাকা সফর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের বেইজিং সফরের ঘটনা এমন সময় ঘটলো যার কয়েক সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে এসে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে।

গত মাসে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের অগ্রগতি দেখতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ ১১টি দেশের কূটনীতিকদের রাখাইনে নিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার।

শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেশে ফেরানোর এই চেষ্টা গত দুই বছর ধরে চলছে, যেখানে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসানচরে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের ওই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর থেকে আর কোনো অগ্রগতি নেই।

তবে তিনি বলেন, “আমরা যে কোনো সময় প্রত্যাবাসন শুরু করতে প্রস্তুত।”

ভূ-রাজনৈতিক কারণে তৎপর চীন ও মিয়ানমার

বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার এই উদ্যোগের পেছনে চীন ও মিয়ানমারের আকস্মিক সক্রিয়তার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার ঘিরে একটি ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা জড়িয়ে আছে। তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও স্বস্তিতে নেই। পশ্চিমা চাপ ও অভ্যন্তরীণ এই সমস্যার ফলে মিয়ানমারে চীনের প্রভাবও খানিকটা কমে এসেছে। এই কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুটাকে তারা সামনে এনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যস্থতায় সক্রিয় হতে চাচ্ছে।”

এই সন্দেহের নেপথ্যে কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ইন্টারনাল ডিসপ্লেস রোহিঙ্গাদেরকে কেন পুনর্বাসন করা হচ্ছে না?”

জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা এবং উদ্বাস্তু ও অভিবাসন বিষয়ক স্বতন্ত্র গবেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “যেহেতু আমেরিকা কিছু রোহিঙ্গাকে তৃতীয় কোনো দেশে রিসেটেলমেন্টের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে, সে কারণে চীনও হয়তো এই ইস্যুতে তৎপর হচ্ছে; এটা বোঝাতে যে তারাও আন্তর্জাতিক সমস্যা নিরসনে উদ্যোগী হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারও হয়তো চিন্তা করছে এটা; যদি কিছু সংখ্যক শরণার্থীর জন্যও হয়, তবে তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলতে পারবে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।” 

রাজনীতির শিকার হতে চায় না রোহিঙ্গারা

নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কোনোভাবে কোনো দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিজেদের ব্যবহার দেখতে চান না।

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের মাস্টার মো. শফি উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসন চাই। যে প্রত্যাবাসনে আমরা সব অধিকার নিয়ে নিজ বাড়ি-ভিটায় ফিরতে পারব। চীন যদি সেটা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে আমাদের আপত্তি নেই। তবে প্রত্যাবাসনের কথা বলে আমরা যেন আর রাজনীতির শিকার না হই।”

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মো. ছলিম বলেন, “এখানে আমরা আর এক মিনিটও থাকতে চাই না। আমরা এখনই নিজ দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু কোথায় যাব আমরা! সেখানে আমাদের বাড়ি-ঘর যেগুলো ছিল এখন তার কিছুই নেই।”

“আমাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে চীন সহযোগিতা করবে সেটা আমরা বিশ্বাস করি না। চীনের সঙ্গে বার্মার ব্যবসা আছে। রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে চীনেরও হাত আছে,” অভিযোগ এই রোহিঙ্গা শরণার্থীর।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মেদ জুবায়ের বেনারকে বলেন, “শুধু চীনের ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। কারণ চীন মিয়ানমারে আমাদের নেটিভ ল্যান্ডে আলি থ্যাংক বিচ এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইকনোমিক জোন করছে।”

“চীন যদি আসলেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় তাহলে আগে মিয়ানমারের সামরিক পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারে আইডিবি ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গা যারা আছে, তাদের নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরিয়ে নিতে হবে। তখনই আমরা বুঝতে পারব চীন আসলেই প্রত্যাবাসনে আন্তরিক,” বলেন জুবায়ের।

এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আমরা জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এবং হস্তক্ষেপে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চাই।

প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে সহায়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।