রোহিঙ্গা সংকট: এবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তা চাইবে আওয়ামী লীগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.05.22
ঢাকা
রোহিঙ্গা সংকট: এবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তা চাইবে আওয়ামী লীগ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বেইজিং যাত্রার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতা মুহাম্মদ ফারুক খানকে (ডান থেকে দ্বিতীয়) ঢাকা বিমানবন্দরে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ঢাকায় চীনা দূতাবাসের ডেপুটি চিফ হাওলং ইয়ান। ২১ মে ২০২৩।
[সৌজন্যে: ফেসবুক/আজিজুস সামাদ আজাদ ডন]

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীন সরকারের পাশাপাশি এবার চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাতে বেইজিং গেছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের একটি প্রতিনিধিদল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ সভপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের এই আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোরে বেইজিং পৌঁছান। বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করেন ফারুক খান।

চীনে অবস্থানকালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পদস্থ নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, যেমন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে তিনি জানান।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বেইজিংয়ের কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল চীন সফরে গেলো। সপ্তাহব্যাপী সফর শেষে তাঁরা ৩১ মে দেশে ফিরবেন।

এদিকে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনকে সামনে রেখে শনিবার টেকনাফের কেরুনতলী প্রত্যাবাসন কেন্দ্র সফর করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।

মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান মিত্র চীনা সরকারের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাঁদের নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

চীনা সরকার বার বার আশ্বস্ত করলেও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার একজনও সেদেশে ফেরত যায়নি।

বর্তমানে কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ বলে জানিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ তাদের বোঝা বহন করতে পারছে না বলে বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ফারুক খান ছাড়াও আওয়ামী লীগ সংসদ-সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ এবং গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ বেইজিং সফরে গেছেন।

সফরে কী নিয়ে আলোচনা হতে পারে—জানতে চাইলে ফারুক খান বেনারকে বলেন, “চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে আমরা বেইজিং যাচ্ছি। এই সফরের এক নম্বর আলোচ্য বিষয় হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। চীন সরকারের পাশাপাশি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা চালাব।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সাথে চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি রয়েছে।”

“আমাদের লক্ষ্য হলো এই বছরের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানো যার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গতি পাবে,” বলেন ফারুক খান।

তিনি বলেন, “মিয়ানমার বুঝেছে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে হবে। সে কারণে তারা খুব সুন্দর ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আলোচনা করছেন।”

দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে বলে তিনি জানান।

ফারুক খান বলেন, “নির্বাচন নিয়ে আমরা আমাদের কথা বলব এবং তাঁরা যদি এই সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে চায় সেটিও আমরা শুনব।”

চীনকে কিছু দিতে হবে

সাবেক রাষ্ট্রদূত তারেক করিম সোমবার বেনারকে বলেন, মিয়ানমারের মিত্র চীন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আশ্বাস দিয়েছে চীন।

তিনি বলেন, “কিন্তু মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক চাপ দেয়নি চীন। চাপ দিলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিত। এখন তারা বলছে যে, তাদের উদ্যোগে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসন শুরু হবে।”

তারেক করিম বলেন, “তবে কোনো প্রকার অর্থনৈতিক অথবা কৌশলগত কিছু পাওয়া ছাড়া মিয়ানমারকে চাপ প্রদান করবে না চীন। সুতরাং চীনকে কিছু দিতে হবে। দেখার বিষয় বাংলাদেশ তাদের কী স্বার্থ রক্ষা করে।”

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান কতটুকু ত্বরান্বিত হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “চীন সরকারের ওপর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব অনেক। সুতরাং, রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে চীন সরকারের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলা সম্ভব বলে আমার মনে হয়।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ চায় যে কোনোভাবেই হোক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক। কারণ, লাখ লাখ বাড়তি মানুষের চাপ বাংলাদেশ নিতে পারবে না। সে কারণে সরকারে চেষ্টা করে যাচ্ছে।”

চীনের সহায়তায় এই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারলে আওয়ামী লীগ এটাকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে আগামী নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারবে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “চীনের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, তারা মূলত ব্যবসা বোঝে। ব্যবসাই তাদের মূল লক্ষ্য বলা যায়। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। তাদের এই স্বার্থ বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে চায়।”

কয়েক বছর অচলাবস্থার পর চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে থাকে মিয়ানমার। এর অংশ হিসাবে ১৫-২২ মার্চ মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল টেকনাফ সফর করে মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী ৪৮০ পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়।

এদের মধ্যে থেকে এক হাজার ১৭৬ জনকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।

প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, অচিরেই মিয়ানমার সরকারের আরেকটি প্রতিনিধিদল টেকনাফ সফর করবে।

রাখাইনের পরিস্থিতি দেখাতে ৫ মে কয়েকজন রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশ সরকারের একটি যৌথ প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের রাখাইন সফর করে।

এর আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক দূত ডেন জি জুং প্রথমে মিয়ানমার এবং পরে ৬-৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সফর করেন।

তবে সরকার প্রত্যাবাসন তৎপরতা শুরু করলেও রোহিঙ্গারা তাঁদের অধিকার ছাড়া রাখাইনে ফেরত যেতে আগ্রহী নন।

প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী কোনো শরণার্থীকে জোর করে সেদেশে ফেরত পাঠাতে পারবে না বাংলাদেশ।

টেকনাফের মৌচনি নূরালীপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মো. আমান উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা চীনার উদ্যোগে প্রত্যাবাসনকে স্বাগত জানাই। অবশ্যই আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই।”

তিনি বলেন, “নিজ দেশে (মিয়ানমার) নাগরিকত্ব দিলে আমরা এই মুহূর্তে চলে যেতে রাজি।”

প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।