জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষতি করছে মানসিক স্বাস্থ্যের, বাড়াচ্ছে সংক্রামক রোগ
2021.10.08
ঢাকা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে নানা রকম সংক্রামক রোগ বাড়ার পাশাপাশি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।
‘জলবায়ুর দুর্ভোগ’ বা ‘ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংক তাদের এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বৃহস্পতিবার এবং এই গবেষণাটির সাথে একমত প্রকাশ করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞরাও।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনে বড়ো ভূমিকা রেখেছে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন। দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭৭ ভাগাই মারা গেছেন ওই বছর।
এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল এবং ওই মাসের বৃষ্টিপাত রেকর্ড ভেঙেছে আগের ৪৫ বছরের।
গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাবের ফলে মৌসুম হোক বা না হোক, ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগের প্রকোপ শহর এলাকায় বাড়ছেই। আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টির মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বেড়ে যেতে পারে।
গবেষণাটি বলছে, জলবায়ু বদলে যাওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে এবং এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা এবং যারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড়ো শহরের বাসিন্দারা।
পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শুকনো মৌসুমে এসব শহরে বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূলে রয়েছে বায়ুদূষণ।
আগে যে সময়টায় শীত থাকার কথা, এখন সেই সময়ে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকছে এবং সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
আগে জুন থেকে আগস্ট সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হতো। এখন এই সময়ে গড় বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে এই সময়ে যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দেয়, তা আরো বেশি সময় ধরে ছড়ানোর উপযোগী তাপমাত্রা পায়।
এই গবেষণা কাজে, বিশ্বব্যাংকের ১৯০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আবহাওয়া, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি ২০১৯ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের শহর ও গ্রাম এলাকার ৩ হাজার ৬০০ খানার ওপর জরিপ পরিচালনা করেছে।
এতে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি থাকে এবং অপরদিকে আর্দ্রতা ১ শতাংশ বাড়লে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ধরা পড়ার আশঙ্কা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে যায়।
গবেষণাটি বলছে, বর্ষাকালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে সংক্রামক রোগের প্রবণতা ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ কমে আসে। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রতি বছর যে সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়, তার ২৫ শতাংশই আক্রান্ত হয় বর্ষাকালে, আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবং অবস্থার সর্বোচ্চ অবনতির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য সমস্যা এতটাই প্রকট হবে যে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ধারণাটি কোনো কাজে আসবে না বলে জানায় গবেষণা।
গবেষণামতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আর ২১০০ সাল নাগাদ তা বেড়ে যেতে পারে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে দাড়াতে পারে ৭৪ মিলিমিটার পর্যন্ত।
একমত বিশেষজ্ঞরাও
পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের ওপর এর কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে এবং বাংলাদেশকে তা মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই বিষয়টি বিশ্বব্যাংক সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছে। স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সংক্রান্ত যে মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক করেছে তা সরকারের সরকারের মূল্যায়নের সঙ্গে মিলে যায়।”
“জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করবে এবং সামনের দশকগুলোতে এর ফল ভোগ করতে হবে তা নিরূপণে সরকার ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্লান (ন্যাপ) তৈরি করেছে। এই তালিকায় কীটপতঙ্গবাহিত রোগ যেমন: কালা জ্বর, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া এবং কলেরা, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হবার হার বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।”
“জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পুষ্টিহীনতা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের নানা রকম সমস্যাও হতে পারে,” যোগ করেন মির্জা শওকত।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া যাতে সম্ভব হয় সেজন্য ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্লান অনুযায়ী সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান মির্জা শওকত।
“তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের বিস্তার। তার মানে হলো তাপমাত্রা বাড়া এবং কীটপতঙ্গ ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে,” বেনারকে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য এবং দেশের অন্যতম ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
“সুতরাং, এটা বলাই যায় যে, বিশ্বব্যাংক ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিরূপ প্রভাব স্বাস্থ্যের ওপর পড়বে তা সঠিকভাবেই তুলে ধরেছে,” বলেন ডা. নজরুল।
তিনি বলেন, “এই বছর আমরা বিপুল সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রোগীদের মারা যেতে দেখছি। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ভিকটিম হিসেবে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তার বিশাল বোঝা আমাদের বহন করতে হবে।”
পরিস্থিতি মোকাবিলায় চার সুপারিশ
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এসবের মধ্যে রয়েছে; স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহে মনোযোগ বাড়ানো; আবহাওয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর প্রকোপের বিষয়ে আগাম সতর্কতা বা পূর্বাভাস দেয়া; মশা নিয়ন্ত্রণে প্রজননস্থল ধ্বংসের মতো কাজে স্থানীয়দের বেশি মাত্রায় সম্পৃক্ত করা এবং নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেয়া।