প্রতিবেদন: গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে স্থানচ্যুত হয়েছেন অন্তত ১৫ লাখ মানুষ

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.05.19
ঢাকা
প্রতিবেদন: গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে স্থানচ্যুত হয়েছেন অন্তত ১৫ লাখ মানুষ কক্সবাজার শাহপরীর দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় মোখায় ভেঙে পড়া ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দুই নারী। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৫ মে ২০২৩।
[এএফপি]

প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত বছর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৫ লাখের বেশি মানুষ তাঁদের নিজস্ব আবাসস্থল থেকে স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি সম্পর্কিত ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার কয়েক দিন আগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংস্থাটি।

মোখার আঘাতে ঘর-বাড়ি হারিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনেক দরিদ্র মানুষ স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।

তবে মোখার আঘাতে বাংলাদেশে মোট কতজন স্থান পরিবর্তন করেছেন সেই তথ্য এখনো সরকারের কাছে নেই বলে শুক্রবার বেনারকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অথবা আদৌ হননি সেটি প্রস্তুত করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।”

ঘূর্ণিঝড় মোখায় মূলত সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ এবং তৎসংলগ্ন টেকনাফ উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে মোখায় ১২ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একটি হিসাব আমরা বলেছিলাম। তবে সেই তথ্যের যথার্থতা মাঠ পর্যায়ে যাচাই বাছাই করছেন আমাদের কর্মকর্তারা।”

তথ্য নেই সরকারের কাছে

চরম আবহাওয়া এবং দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে মানুষের বাসস্থান ত্যাগ করার বিষয়টি নিয়ে “সন্দেহ নেই,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী।

তবে দুর্যোগের কারণে কত মানুষ বাসস্থান ত্যাগ করেন “সরকারের কাছে এ সম্পর্কিত তেমন তথ্য নেই,” বলে জানান তিনি।

তাঁর মতে, “বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুতির বিভিন্ন দিক রয়েছে। এটি এমন নয় যে, একজন মানুষ দুর্যোগের পর বাস্তুচ্যুত হয়ে চিরতরে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। অধিকাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে আসেন, কাজের সুযোগ নেন, কিছুটা অর্থ আয় করে কিছু দিন পর আবার তাঁর নিজ নিজ মূলে ফিরে যান।”

“কিছু মানুষ যাদের গ্রামে কোনো সম্পত্তি থাকে না অথবা শহরে ভালো কাজের সুযোগ পেয়ে যান, তাঁরা শহরেই থেকে যান,” বলেন মির্জা শওকত আলী।

“মোটা দাগে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির বিষয়ে বলা যাবে না একটি বছরে এক মিলিয়ন বা দেড় মিলিয়ন মানুষ দুর্যোগজনিত কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন,” যোগ করেন তিনি।

অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ সম্পর্কে সরকারের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের প্রতিবেদনটিকে “ভুল বলা যাবে না” বলে মন্তব্য করেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতি বিষয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের প্রধান হাফিজ খান।

“জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে এটি সব গবেষণায় বলা হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “জেনেভা থেকে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ দুর্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত অথবা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেখতে হবে এই প্রতিবেদন কীসের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে? তথ্যের উৎস কী? এই দুর্যোগগুলো কি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত?”

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো গবেষণা করা হয়নি জানিয়ে হাফিজ খান বলেন, “সরকারের উচিত এই প্রতিবেদনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি সম্পর্কে একটি গবেষণা করা।”

ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বের ১১০টি দেশে সাত কোটি ১১ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে শতকরা ২০ শতাংশ বেশি এবং সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগে এত মানুষ কখনো অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হননি।

দক্ষিণ এশিয়ায় ২০২২ সালে দেড় কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থান পরিবর্তন করেছেন। তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানে প্রায় ৮২ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থান পরিবর্তন করেছেন অথবা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতে এই সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি এবং আফগানিস্তানে দুই লাখ ২০ হাজার ও নেপালে ৯৩ হাজার।

বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ, যুদ্ধ-সংঘাত ও খাদ্য সংকট।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দুর্যোগ সম্পর্কিত ২০২১ সালের প্রকাশনা অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৭৫ লাখের বেশি বাড়ি-ঘর বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর মধ্যে ৪১ লাখের বেশি বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ২৫ লাখের বেশি। এসব বাড়িঘরের প্রায় অর্ধেকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একাধিকবার।

উল্লেখ্য, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

সরকারি গবেষণা, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল অংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বেড়ে যাবে, বাস্তুচ্যুত হবে লাখ লাখ মানুষ।

IMG-6510.jpg
নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে বর্তমানে বাঁধের উপর ঘর বেঁধে বসবাস করছেন এই নারী ও তাঁর পরিবার। ছবিটি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের গাবুরা থেকে তোলা। ২ মে ২০২৩। [বেনারনিউজ]

একবার বাড়ি ভাঙল, আরেক জায়গায় বানালাম, ওটাও গেলো

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় সমুদ্র পাড়ে অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ এলাকার মাঝারপাড়ায় বসবাসকারী সত্তরোর্ধ্ব খাতিজা বেগমের ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত করেছে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মোখা।

তিনি বলেন, “একমাত্র সম্বল ছিল একটি ঝুপড়ি ঘর। সেই ঘরও ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। নদীতে তলিয়ে গেছে ঘরের ভিটেমাটি। এখন যাওয়ার জায়গা নেই।” বলেন খাতিজা বেগম।

ঝড়ের পরে তাঁর “পাশের ঘরের দুই বাসিন্দা গ্রাম ছেড়েছেন,” বলেও জানান খাতিজা।

গাইবান্ধা সদর উপজেলা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকার পল্লবীর দুয়ারীপাড়া বস্তিতে বসবাস করেন ফিরোজা বেগম (৪৫)। তিন দফা বন্যা ও ভাঙনে ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়েছে তাঁর ঘর-বাড়ি।

ফিরোজা বেনারকে বলেন, “একবার বাড়ি ভাঙল, আরেক জায়গায় বানালাম। এরপর ওটাও গেল। আবার বানালাম, আবার গেল। কতবার পারা যায়!”

“চলে এলাম। আর যাব না। এখানে বাসা-বাড়িতে কাজ করে খাই। আল্লাহ চালায় নেয় কিন্তু আমার স্বামী আসেনি। সে ওখানে ভাই-বোনের বাড়িতে থাকে। আমি টাকা পাঠাই,” বলেন তিনি।

প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।