জলবায়ু পরিবর্তন: ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য শত বিলিয়ন ডলারের তহবিল দূরে রেখে ২০০ মিলিয়নের ‘গ্লোবাল শিল্ড’

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.11.15
ঢাকা
জলবায়ু পরিবর্তন: ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য শত বিলিয়ন ডলারের তহবিল দূরে রেখে ২০০ মিলিয়নের ‘গ্লোবাল শিল্ড’ জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে থাকা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া বালুর বস্তায় বসে আছেন কয়েকজন পর্যটক। ২৪ অক্টোবর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। কিন্তু সোমবার উন্নত দেশগুলো ২০০ মিলিয়ন ডলারের ‘গ্লোবাল শিল্ড’ তহবিল গঠন করেছে।

বাংলাদেশের সরকার ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ওই তহবিল থেকে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে, তবে নতুন এই তহবিলের অংশীদার বিশ্বের মোট ১৩০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন মঙ্গলবার প্রতিশ্রুত টাকা দিতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের এই মন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমান শতাব্দীর শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শতকরা ১২ থেকে ১৭ ভাগ এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও একদিকে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না, অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে রেকর্ড পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ অব্যাহত রয়েছে।

মিশরের অবকাশযাপন কেন্দ্র শার্ম-আল-শেখে চলমান জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ-২৭) মঙ্গলবার মন্ত্রী বলেন, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোকে রক্ষা করতে বর্তমান সময়ের চেয়ে সাত গুণ বেশি হারে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড প্রদানে ঐকমত্য না হলেও প্রথমবারের মতো জলবায়ু সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়টি সম্মেলনে উত্থাপিত হয়েছে। এর আগে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আর্থিক প্রতিদান চেয়ে আসলেও দূষণকারী উন্নত দেশগুলোর আপত্তির কারণে বিষয়টি উপস্থাপন করাও সম্ভব হয়নি।

কপ-২৭ সভায় বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ক্ষতিকারক কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৮ ভাগ। কিন্তু দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার।

বিশ্বে শিল্পায়নের ফলে বেশি বেশি জীবাশ্ম জ্বালানী যেমন কয়লা ও পেট্রোলিয়াম পোড়ানোর ফলে জলবায়ুতে বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, মিথেন, সালফার ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গত হয়। এর ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলে সেই পানি সমুদ্রে পড়ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব বেশি উচ্চতায় না থাকা দেশ ও অঞ্চল পানিতে ডুবে যাবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। এতে বাস্তচ্যুত হবে কোটি কোটি মানুষ।

বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে রক্ষা করতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রথমে কিয়োটো প্রটোকল এবং ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। এরপর থেকে তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমাতে হবে।

তাপমাত্রা কমাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কমাতে হবে এবং বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমাতে হবে যা তারা রাজি নয় বলে মনে করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।

উল্লেখ্য, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দূষণ করে চীন এবং এর পরেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

১০০ বিলিয়ন ডলার বনাম শিল্ড ফান্ড

প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ দেয়ার কথা উন্নত দেশগুলোর।

কিন্তু সেই আলোচনা এখনও শেষ হয়নি বলে মঙ্গলবার শার্ম-আল-শেখ থেকে বেনারকে জানান, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর উপপরিচালক মিজান আর খান।

তিনি বলেন, সোমবার উন্নত দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর সমর্থনে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের শিল্ড ফান্ড গঠিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এই তহবিল থেকে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে।

“তবে এই সম্মেলনে এই ফান্ড গঠন নিয়ে একটি সমালোচনা চলছে। সেটি হলো: সমালোচকরা বলছেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সাথে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদান সম্পর্কিত যে আলোচনা চলছে সেটির ওপর থেকে নজর ফেরাতেই এই ২০০ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করা হয়েছে,” যোগ করেন মিজান আর খান।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিজের প্রধান ড. আতিক রহমান বেনারকে বলেন, শিল্ড ফান্ড নামে একটি নতুন ফান্ড গঠিত হলেও এর বৈশিষ্ট্যগুলো এখনও বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।

“আমরা যতটুকু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি তাতে এই ফান্ডের পরিমাণ ২০০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এই টাকা মোট ১৩০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ভাগ হবে। এখন বুঝে নিন কত টাকা প্রতিটি দেশের ভাগে পড়বে,” যোগ করেন তিনি।

ড. আতিক রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আলোচনায় দুটি শব্দ ব্যবহার করা যায় না। একটি হলো ক্ষতিপূরণ এবং আরেকটি হলো অ্যাট্রিবিউশন। অর্থাৎ ধনী-উন্নত দেশগুলোর দূষণ করবে এবং এর ফলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে অনুন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু আলোচনায় বলা যাবে না, কারা এই দূষণের জন্য দায়ী।

তিনি বলেন, আবার তাদের যখন বলা হবে তোমাদের জন্য আমাদের ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, সেজন্য আমাদের ক্ষতিপূরণ দাও—তখন তারা কিছু টাকা দেবে। কিন্তু সেটিকে ক্ষতিপূরণ বলা যাবে না।

আতিক রহমান বলেন, “শিল্ড ফান্ডের এই সামান্য টাকা দিয়ে উন্নত দেশগুলো বলবে তারা জলবায়ুকে রক্ষা করছে। আমি মনে করি, এই ফান্ডের অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করা ছাড়াও এর পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ঠিক করতে হবে।”

বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বেনারকে বলেন, “নতুন সৃষ্টি করা শিল্ড ফান্ড থেকে আমরা কিছু টাকা পাব, সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা তহবিল চাই। শিল্ড ফান্ডের সাথে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড এক করে ফেলা যাবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।