ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার পরিবেশবাদীরাও: জাতিসংঘের দূত

আহম্মদ ফয়েজ
2022.09.15
ঢাকা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার পরিবেশবাদীরাও: জাতিসংঘের দূত নদীভাঙনের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। ভেঙে পড়া পদ্মাপারের এই ছবিটা মুন্সীগঞ্জ থেকে তোলা। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২। [বেনারনিউজ]
[বেনারনিউজ]

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সোচ্চার মানবাধিকারকর্মী এবং আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হয়রানি, হুমকি এবং ভয় দেখানো বন্ধ করতে বাংলাদেশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সংশোধনের তাগিদ দিয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়ান ফ্রাই।

দশ দিনের সফর শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ফ্রাই বলেন, “যদিও সরকার অস্বীকার করে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে তৎপর মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে না, তবু্ও এটা নিশ্চিত করতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে জনসাধারণ যাতে অবাধে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।”

তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা দরকার যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের মানবাধিকার রক্ষাকারীরা এবং আদিবাসীরা সন্ত্রাস সম্পর্কিত বিস্তৃত সংজ্ঞাগত সমস্যায় না পড়েন।

“যারা জলবায়ু সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন, তাঁরা সন্ত্রাসী নন," যোগ করেন তিনি।

জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞের দাবির সাথে একমত পোষণ করে বাংলাদেশের প্রখ্যাত পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, “যারা দেশের জমি দখল এবং জলাশয় ও বন ধ্বংসের সাথে জড়িত তাঁদের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি নতুন অস্ত্র হয়ে উঠেছে।”

“শুধু পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরাই নয়, সাধারণ মানুষও পরিবেশ রক্ষার কথা বলে হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। যেহেতু মানুষ এখন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দখলকারীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হন, তাই এই পরিস্থিতিতে আইনটি দখলদারদের জন্য সুরক্ষা কবজ হয়ে উঠেছে,” যোগ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা।

তিনি জানান, শাহনেওয়াজ চৌধুরী নামে একজন প্রকৌশলীকে গত বছরের মে মাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

“ফেসবুক পোস্টে ওই প্রকৌশলী পরিবেশের উপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নেতিবাচক প্রভাবের সমালোচনা করেছেন এবং তিনি প্ল্যান্ট মালিকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন,” বলেন রিজওয়ানা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের জন্য জাতিসংঘের প্রতিনিধির আহবান সম্পর্কে জানতে চাইলে বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির প্রধান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বেনারকে বলেন, “সরকার এই আইনটিকে সংশোধনের জন্য বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সাথে কাজ করছে। এর অপব্যবহার রোধে সরকার আন্তরিক।”

“আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। প্রতিটি সমস্যা এবং উদ্বেগের সমাধান করা হবে। সরকার সব ধরনের আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে,” বলেন মোজাম্মেল হক।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪৩৩ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে বন্দি করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই অভিযোগ অনলাইনে ‘মিথ্যা এবং আপত্তিকর’ তথ্য প্রকাশ।

সরকার সমালোচক, বিশেষ করে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, আন্দোলনকর্মী, শিক্ষাবিদ এবং ছাত্ররা এই আইনের শিকার হচ্ছেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সংসদে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এই আইনটি পাস করে, যা নিয়ে পরবর্তীতে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়।

সফরের সময় ফ্রাই সরকারের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক দাতা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, কমিউনিটি কাউন্সিল এবং নাগরিক সমাজ সংস্থার সদস্যদের সাথে দেখা করেন এবং গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেন।

তিনি ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, খুলনা ও সাতক্ষীরা সফর করেন।

জলবায়ুর বোঝা বাংলাদেশের একার নয়

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশকে চরম আবহাওয়ার প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক তহবিলের আহবান জানিয়ে ফ্রাই বলেন, “নিশ্চয়ই জলবায়ু পরিবর্তনের ভার বাংলাদেশ একা বহন করতে পারে না।”

“আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিকূলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু অঞ্চল পরিদর্শন করেছি এবং এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে জলবায়ু পরিবর্তনের ভার বাংলাদেশের একা বহন করা উচিত নয়। খুব দীর্ঘ সময় ধরে, প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলো তাদের দায় অস্বীকার করেছে। এটি অবশ্যই শেষ হওয়া উচিত," যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার জন্য অর্থায়নে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে প্রধান গ্রিনহাউস নির্গমনকারী দেশগুলোর সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তাঁর মতে, আঞ্চলিক নদীর প্রবাহের আওতায় থাকা দেশগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে এবং একটি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত আঞ্চলিক নদী প্রবাহ পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারকে তার জলবায়ু পরিবর্তন পরিকল্পনায় আরও ব্যাপকভাবে পরামর্শ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই ধরনের পরিকল্পনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পাওয়া যাবে।

জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে নারী, বয়স্ক ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন ফ্রাই। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কীভাবে মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি সুস্পষ্ট নীতি ও কৌশল তৈরি করা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, বস্তিতে বসবাসকারী মানুষদের আরও ভালো সেবা দিতে হবে।

ফ্রাই ২০২২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন, যা জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, ক্ষয়ক্ষতি এবং অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রচার এবং সুরক্ষার ওপর নজর দেবে।

এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০২৩ সালের জুনে ফ্রাই’র বাংলাদেশ সফরের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপন করা হবে।

১৯৯৮ সাল থেকে ২০ বছরে চরম আবহাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।