শীতে কাঁপছে বাংলাদেশ, দুই মাসে শীতজনিত রোগে মৃত্যু ৬২
2024.01.17
ঢাকা
কনকনে ঠাণ্ডা ও ঘন কুয়াশায় বাংলাদেশে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, গত ১৫ নভেম্বর থেকে বুধবার পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা বিভাগে ছয়জন, ময়মনসিংহ বিভাগে তিনজন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩০ জন, রাজশাহী বিভাগে একজন, রংপুর বিভাগে চারজন, বরিশাল বিভাগে একজন ও সিলেট বিভাগে ১৭ জন মারা গেছেন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, গত ১৫ নভেম্বরের পর থেকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগ নিয়ে প্রায় আড়াই লাখ রোগী ভর্তি হয়েছেন।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হাসান অমি বেনারকে বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছে, তার ৭০ শতাংশই ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে আসছে। ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে তারা আসছে হাসপাতালে।”
ছয় বছর বয়সী ছেলে সুমন রহমানকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে এসেছেন সুমাইয়া রহমান। তিনি বেনারকে বলেন, “তিনদিন ধরে আমার ছেলে জ্বর, সর্দি ও কাশি। নিউমোনিয়া শনাক্ত হওয়ার পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে দেখি হাসপাতালে এ রকম রোগীর সংখ্যা প্রচুর।”
উত্তরাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড়
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। চলতি মাসের ৩ তারিখ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সাত দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. ইউনুস আলী বলেন, “শয্যা সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি রোগী আসছে, আমরা সেবা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
রোগীর ভিড় বেড়েছে রাজশাহীর হাসপাতালগুলোতেও।
রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বেনারকে বলেন, “এই এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। সাধারণত এই সময়ে রোগীর চাপ কিছুটা বাড়ে। হাসপাতালগুলো চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
নওগাঁর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে বেড়েছে সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
নওগাঁ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. রিফাত হাসান বলেন, “শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।”
হাসপাতালে ঠাণ্ডাজনিত রোগের ওষুধের সংকট আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “পাশের জেলা থেকে ওষুধ এনে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে।”
বাড়ছে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা
স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গত কয়েক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে আগুনে পুড়ে বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত বা মৃত্যুর সংখ্যা স্বাস্থ্য বিভাগ সংরক্ষণ করে। শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে আগুন পোহাতে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কোথাও সংরক্ষণ করা হয় না।
বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স লিংকন দত্ত সাংবাদিকদের জানান, চলতি মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত দগ্ধ ১৪ জন রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ আগুন পোহাতে গিয়ে অথবা গরম পানিতে ঝলসে যাওয়া রোগী।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ডা. আফরোজা নাজনীন জানান, হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে, বারান্দায় ও মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, “গত দুই সপ্তাহে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আগুনে পোড়া অর্ধশতাধিক রোগী। এই রোগীদের একজনের মৃত্যু হয়েছে।”
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি আগুনে পোড়া দুই রোগীর মৃত্যু হয়, ওই দুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল অগ্নিদগ্ধ ৪৪ রোগী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বেনারকে বলেন, “শীতের সঙ্গে সঙ্গে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই সংখ্যাটা বছরের অন্য সময়ের চেয়ে চার গুণেরও বেশি।”
দুর্ঘটনা এড়াতে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
স্কুল ছুটির সিদ্ধান্ত
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। মঙ্গলবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেয়।
এতে বলা হয়, “দেশের বিভিন্ন জেলায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে। চলমান শৈত্যপ্রবাহে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মর্মে জানা যাচ্ছে। যেসব জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে (সংশ্লিষ্ট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রমাণক অনুযায়ী) নেমে যাবে, আঞ্চলিক উপপরিচালকরা ওইসব জেলার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করবেন।”
পদ্মায় ফেরি ডুবেছে
বুধবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে বাল্কহেডের ধাক্কায় পদ্মা নদীতে একটি ফেরি ডুবে গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহন বোঝাই ফেরিটি নদীর মাঝখানে আটকা পড়েছিল।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বেনারকে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “সকাল সোয়া ৮টার দিকে ৫ নম্বর টার্মিনালের কাছে রজনীগন্ধা ফেরিটি কমপক্ষে সাতটি যানবাহন নিয়ে ডুবে গেছে।’’
বিআইডব্লিউটিসির এই কর্মকর্তা জানান, গভীর রাতে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসে ফেরি রজনীগন্ধা। ভোর রাতে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া প্রান্তে পৌঁছায়। ঘন কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা কমে আসায় মাঝনদীতে অনেকক্ষণ নোঙ্গর করে থাকে।
সকালে কুয়াশা কমে এলে তীরে আসতে শুরু করে। সে সময় একটি বাল্কহেড পাশ থেকে ধাক্কা দিলে ফেরিটি ডুবে যায়।
বৃষ্টির পূর্বাভাস
হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশার দাপটও বেড়েছে। আর এর প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
ভোরে ঘন কুয়াশা থাকায় সড়ক ও মহাসড়কে যানবাহনগুলো ফগ বা হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামায় সমস্যা হয়েছে। ফেরি চলাচলেও বিঘ্ন ঘটেছে। এমন শীত থেকে সহসা মুক্তি মিলছে না বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
বুধবার সকাল ৯টায় আবহাওয়া অধিদপ্তর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানিয়েছে, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে।
এটি কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে জানিয়ে বলা হয়, কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িক বিঘ্ন ঘটতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ফাতিমা আক্তার বেনারকে বলেন, “আমরা এই ঠাণ্ডা পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত নই। তাই এটি মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
তিনি বলেন, “একটি আর্দ্র, উষ্ণ জলবায়ুতে বসবাস করে অভ্যস্ত বাংলাদেশিদের এই শীত মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত গরম পোশাক ও পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে।”