করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তৃতি প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.01.28
ঢাকা
করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তৃতি প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে জাতীয় সংসদের সামনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দুর্নীতি বিরোধী মানববন্ধন। ৮ ডিসেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনো উদ্বেগজনক, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে যার ভয়াবহতা আরো প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। 

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সংস্থাটির ২০২০ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) বলা হয়, কম দুর্নীতিপ্রবণ দেশগুলো করোনাভাইরাস সংক্রমণ সঠিকভাবে মোকাবেলা করেছে এবং বাংলাদেশের মতো ‘দুর্নীতিপ্রবণ’ দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির কারণে মহামারি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায়নি। 

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। করোনাভাইরাস পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তারও হন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের একাধিক কর্ণধার।

মহামারি নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনার অভিযোগে সমালোচনার মুখে জুলাইতে পদত্যাগ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ।

“কোভিড-১৯ শুধু স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট নয়। এটি দুর্নীতিরও সংকট যা আমরা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছি,” প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে বলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান ডেলিয়া ফেরেইরা রুবিও। 

কম দুর্নীতিপ্রবণ দেশগুলোর করোনাভাইরাস মহামারি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ৭১ পয়েন্ট পেয়ে ২১তম অবস্থানে থাকা উরুগুয়ে স্বাস্থ্যখাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। দেশটিতে শক্তিশালী রোগতাত্ত্বিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এর ফলে তারা কোভিড-১৯, ইয়োলো ফিভার ও জিকা ভাইরাস সংক্রমণ খুব ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে। 

অন্যদিকে ১৪৬তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে খুব সামান্য বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে মহামারিতে এখানে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। যেমন ক্লিনিকগুলোতে ঘুষ শুরু হয় এবং অনুদান সামগ্রী তছরুপের ঘটনা ঘটে। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ২৬ পয়েন্ট নিয়ে জরিপকৃত ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬, যেখানে শূন্য স্কোর হচ্ছে সর্বোচ্চ ও ১০০ স্কোর হচ্ছে সর্বনিম্ন দুর্নীতির নির্দেশক। 

এবার দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে কেবল আফগানিস্তান (১৯ পয়েন্ট)। টিআই’র দুর্নীতি সূচকে এর আগের দুই বছরও বাংলাদেশের স্কোর পয়েন্ট ছিল ২৬। 

প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। 

সূচকে বাংলাদেশের স্কোর তৃতীয়বারের মতো অপরিবর্তিত থাকায় “আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই,” বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

“নিম্নক্রম অনুসারে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে থাকা সোমালিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিতে শীর্ষ অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানের মতো দেশেরও স্কোর তিন পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে,” জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক গড় স্কোরের (৪৩) তুলনায় এবারও বাংলাদেশের স্কোর উল্লেখযোগ্যভাবে কম। 

“গতবারের মতোই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে থাকায় দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনো উদ্বেগজনক। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রেক্ষাপটে যার ভয়াবহতা ও বিস্তৃতি প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। 

এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শুধুই প্রতিশ্রুতি’ কিংবা ‘অস্বীকারের সংস্কৃতি’ আর ‘স্বল্প পরিসরের অভিযানে’র বাইরে গিয়ে আরো বিস্তৃত, কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানায় টিআইবি। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১২ পয়েন্ট পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলে বিবেচিত হয়েছে সোমালিয়া ও সাউথ সুদান। ৮৮ পয়েন্ট নিয়ে যৌথভাবে সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হয়েছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। 

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ভুটান (৬৮)। 

‘সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার’

বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলে সরকার বদ্ধপরিকর বলে বেনারকে জানান আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল মতিন খসরু।

তবে তাঁর মতে, “দুর্নীতি দূর করা সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, কারণ আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট দুর্নীতির ধরনকে পাল্টে দিয়েছে।”

“আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের জটিল দুর্নীতির মামলা অনুসন্ধান করে বিচার করার সক্ষমতা নেই,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আধুনিক যুগে দুর্নীতি কমাতে বহুমাত্রিক পরিকল্পনা ও অ্যাপ্রোচ দরকার।”

“দেশ থেকে দুর্নীতি কমাতে হলে শুধু সরকার নয় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ দুর্নীতি সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এটিকে রুখতে গেলে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন দরকার,” বলেন আব্দুল মতিন খসরু।

বেনারের পক্ষ থেকে টিআই প্রতিবেদনের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেননি। 

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের জন্য কমিশনের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কমিশন প্রতিবেদনটি দেখে পরবর্তী কার্যদিবসে প্রতিক্রিয়া জানাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।