সরকারের মতে, সেনাপ্রধান ও তাঁর ভাইদের সম্পর্কে আল জাজিরার প্রতিবেদন ‘নোংরা অপপ্রচার’

জন ব্যাকটেল
2021.02.02
ওয়াশিংটন ডিসি
সরকারের মতে, সেনাপ্রধান ও তাঁর ভাইদের সম্পর্কে আল জাজিরার প্রতিবেদন ‘নোংরা অপপ্রচার’ কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ (ডানে)। ২৪ নভেম্বর ২০১৯।
[এএফপি]

“মিথ্যা ও অবমাননাকর” আখ্যা দিয়ে সেনাপ্রধানের পরিবারের অবৈধ ফায়দা নেবার অভিযোগ করে আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। 

তথ্যচিত্র ভিত্তিক ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য নিষিদ্ধ হলেও সামরিক বাহিনীর জন্য ইসরাইলে নির্মিত সেলফোন নজরদারির প্রযুক্তি কিনতে সেনাপ্রধান তাঁর এক ভাইকে গোপনে সাহায্য করেছেন।

তাঁর ওই ভাই খুনের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ও পলাতক বলেও জানানো হয় ওই তথ্যচিত্রে।

‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ বা ‘তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর লোক’ শিরোনামে এক ঘণ্টার ইংরেজি ভিডিওটি গত সোমবার প্রকাশ করে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার তদন্ত বিভাগ (আই-ইউনিট)।

তথ্যচিত্রটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের তিন ভাই ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরে আলোচিত মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের দায়ে দণ্ডিত, যাদের দুজনই পলাতক এবং একজন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ।

এতে বলা হয়, সেনাপ্রধানের ভাই হারিস আহমেদ পরিচয় বদলে হাঙ্গেরিতে ‘মোহাম্মদ হাসান’ নামে বসবাস করছেন। অন্য ভাই আনিস আহমেদ রয়েছেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। তাঁরা দুজনই মোস্তফা হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত হবার পর পলাতক।

তৃতীয় ভাই জোসেফ আহমেদ ওই হত্যা মামলায় ২০ বছর জেল খেটে রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ছাড়া পেয়েছেন।

প্রসঙ্গত, জেনারেল আজিজ আহমেদ বর্তমানে সরকারি সফরে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। 

গোপনে সংগ্রহ করা বিভিন্ন নথিপত্র দেখিয়ে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, সেনাপ্রধান তাঁর ভাইয়ের জন্য ভুয়া পাসপোর্ট ও অন্যান্য ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করতে সেনা কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছেন।

তথ্যচিত্রটি প্রকাশের আগে এক বিবৃতিতে আল জাজিরা জানায়, “গোপনে রেকর্ড করা জেনারেল আহমেদের (আজিজ আহমেদ) ফোন কথোপকথন সংগ্রহ করেছে আই-ইউনিট, যেখানে তাঁর ভাইয়েরা কীভাবে ১৯৮০ ও ১৯৯০’র দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতার সাথে তাঁর ভাইদের দৃঢ় বন্ধন তৈরি হওয়ার কথাও জানান জেনারেল।” 

হারিস আহমেদ বিভিন্ন ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করছেন এমন ভিডিও ক্লিপও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তথ্যচিত্রটিতে।

“এমনকি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হারিস যদি কিছু করতে চায় তবে তাকে তা করতে দাও। আমরা সাহায্য করব,” তথ্যচিত্রের একটি ভিডিও ক্লিপে বলেন হারিস।

“গোপনে ধারণ করার সময়, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঠিকাদারি ও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণদের ঘুষের মধ্যস্থতা করে কীভাবে অঢেল অর্থ উপার্জন করেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন তিনি (হারিস)। এটি বাংলাদেশের পুলিশ ও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির একটি কাঠামোবদ্ধ চক্র,” বিবৃতিতে বলে আল জাজিরা।

তবে আল জাজিরার প্রতিবেদনটিকে বাংলাদেশের বিপক্ষে “বেপরোয়া ও নোংরা অপপ্রচার” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সরকার। 

সোমবার প্রকাশিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই প্রতিবেদন একগুচ্ছ বিভ্রান্তিকর শ্লেষ আর বক্রোক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়, যা আসলে চরমপন্থী গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কুখ্যাত ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘অপপ্রচার’।” 

এই গোষ্ঠীটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ১৯৭১ সাল থেকেই রাষ্ট্রের “প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরোধিতা” করে আসছে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, আল জাজিরার প্রতিবেদনের মূল সূত্র এক “সন্দেহভাজন আন্তর্জাতিক অপরাধী,” যাকে আল জাজিরা নিজেই “সাইকোপ্যাথ” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, ওই ব্যক্তিকে ‘সাইকোপ্যাথ’ বা মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করলেও এর কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি আল জাজিরার প্রতিবেদনে। 

“প্রধানমন্ত্রী বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই বিশেষ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম প্রমাণও নেই। আর মানসিক ভারসাম্যহীন কারো কথার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা একটি আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলের জন্য চরম দায়িত্বহীনতা,” বলা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে। 

মালয়েশিয়ায় পারিবারিক অনুষ্ঠান

আল জাজিরার প্রতিবেদনে সেনাপ্রধানের ভাই আনিস আহমেদের কুয়ালালামপুরের বাসায় একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাঁদের সব ভাইদের মিলিত হবার ভিডিও দেখানো হয়। এতে বলা হয়, দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে আনিস আহমেদ ওখানেই বসবাস করছেন। 

ওই ভিডিওতে দেখা যায় কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে অবতরণের পর সেনাপ্রধানকে নিতে তাঁর দুই ভাই এসেছেন। তবে তাঁদের সাথে দেখা না করে আলাদা আলাদা গাড়িতে তাঁরা সবাই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দিকে যাচ্ছেন।

মালয়েশিয়ায় বসবাসরত আনিস আহমেদ সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দেশটির পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এক্রিল সানি। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে তাঁরা কোনো অনুরোধ পাননি বলেও জানান তিনি।

“সর্বপ্রথম আমাদের দেখতে হবে ওই ব্যক্তি এখনো এখানে (মালয়েশিয়া) রয়েছেন কি না, এবং তিনি ইন্টারপোলের পরোয়ানাভুক্ত কি না,” সোমবার কুয়ালালামপুরে সাংবাদিকদের বলেন এক্রিল। 

বিবৃতিতে আল জাজিরা জানায়, প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে এ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কেউ কোনো মন্তব্য করেননি। 

নজরদারি সরঞ্জাম

ইসরাইলে তৈরি নজরদারি যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে আল জাজিরার অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। তথ্যচিত্রে বলা হয়, ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণও দিয়েছেন।

ওই সব যন্ত্রপাতি দিয়ে এক সাথে কয়েক শ মোবাইল ফোন নজরদারি করা সম্ভব। হারিস আহমেদ এই সরবরাহ প্রক্রিয়ায় মূল ব্যক্তি ছিলেন বলে জানায় আল জাজিরা।

তবে ইসরাইল থেকে মোবাইল ফোন মনিটর করার যন্ত্রপাতি কেনা সম্পর্কে আল জাজিরার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ওই অভিযোগকে “সাজানো এবং দুরভিসন্ধিমূলক” বলে আখ্যায়িত করে।

বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।”

“ক্রয়কৃত সরঞ্জাম কিংবা এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্রেই এগুলো ইসরায়েলের তৈরি বলে উল্লেখ নেই,” জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় উক্ত দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয় কিংবা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই।” 

যুক্তরাষ্ট্র সফর

বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বর্তমানে সরকারি সফরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। চলতি মাসের ১২ তারিখ তাঁর দেশে ফেরার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর। 

সফরকালে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধান ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পেন্টাগনের কর্মকর্তারা। তবে ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ এই সফরের বিস্তারিত জানাতে তাঁরা অস্বীকার করেন।

“আমরা আল জাজিরার অভিযোগগুলো সম্পর্কে অবগত। চলমান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার অংশ হিসেবে সহযোগী দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের আমরা আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকি,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লে. কর্নেল কার্টিস কেলগ। 

“যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বিদ্যমান, যার মধ্যে রয়েছে নিয়মিত যৌথ মহড়া, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিনিময় এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সহায়তা। দুই দেশই আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” বলেন কার্টি কেলগ। 

এদিকে আল জাজিরার প্রতিবেদন সম্পর্কে বক্তব্য জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করেও তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।