বাজেট অধিবেশনজুড়ে সংসদে দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা, দুদকের ওপর অনাস্থা
2024.06.28
ঢাকা
গত সপ্তাহজুড়ে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন মূল আলোচনার বিষয় ছিল দুর্নীতি। দুই ডজনের বেশি সরকার দলীয় ও বিরোধী সংসদ সদস্য দুর্নীতির লাগাম টানতে প্রয়োজনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানান।
শুক্রবার পর্যন্ত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কেউ এ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগের কথা জানাননি।
সাবেক পুলিশ ও সেনাপ্রধান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষস্থানীয়সহ পাঁচ কর্মকর্তা দুর্নীতির তথ্য সম্প্রতি একে একে সামনে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে সরকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কেননা এদের প্রায় সবাই সরকারের আস্থাভাজন। সেই কারণেই সরকার কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করছে।
তাঁরা আরও বলেন, অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও একজন সাবেক সেনাপ্রধান ও একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি নেই।
আস্থা সংকটে দুদক
দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে জাতীয় সংসদে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুই ডজনের বেশি সরকার দলীয় ও বিরোধী সংসদ সদস্য।
তাঁরা বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেই দুদকের পদক্ষেপ গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে।
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, সরকারের ভেতরে দুর্নীতিবাজ থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা নেই।
দুর্নীতি বন্ধে বিশেষ কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছেন প্রবীণ সংসদ সদস্য ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
তিনি শুক্রবার বেনারকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন স্থবির ও অকার্যকর হয়ে আছে।
“বিশেষ কমিশন গঠনের বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে এর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হতে পারে,” বলেন তিনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, আস্থার সংকটের কারণেই দুর্নীতি দমন কমিশন থাকার পরও পৃথক সংস্থা বা টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব আসছে।
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে শুক্রবার তিনি বলেন, “রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবের কারণেই কিন্তু দুদক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। দুর্নীতি দমনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থাকলেও সেটা কার্যকর নয়।”
সংসদ সদস্যদের বৈপরীত্য
যে সংসদে কালোটাকা সাদা করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা, সেই সংসদে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান বৈপরীত্য বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বেনারকে বলেন, "যেভাবে এমপিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, এটা ইতিবাচক। কারণ তাঁদের মাঝেও এক ধরনের হতাশা এসেছে। সংসদে যারা জনপ্রতিনিধি হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সেই সংসদে তারাই কিন্তু ভোট দিয়ে কালো টাকা সাদা করার আইন পাস করবেন। এটা এক ধরনের বৈপরীত্য ও নৈতিক স্খলন।”
এদিকে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষ কমিশন গঠনের দাবি দুদকের প্রতি অনাস্থার সামিল—তা মনে করেন না দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।
তিনি বেনারকে বলেন, “দুর্নীতি দমনে দুদকের যে আইন বা কার্যক্রম চলমান আছে, সেটা পর্যাপ্ত। সেটা যদি ভালোভাবে কার্যকর হয়, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
তবে দুর্নীতি দমনে নতুন কোনো আইন পাস হলে বা কমিশন গঠন করা হলে স্বাগত জানাবেন বলেও উল্লেখ করেন এই আইনজীবী।
দুই কর্মকর্তার তদন্তে অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়
সরকারের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর তিনজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, বাকি দুজনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান।
আছাদুজ্জামান বিদেশে অবস্থান করছেন এবং গত ২২ জুন এক ভিডিও বার্তায় তিনি দেশে ফেরার কথা জানিয়েছিলেন।
গণতন্ত্রের অবনতি ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। তবে, দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের খবর প্রকাশের পর তাঁকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এই কর্মকর্তা ও তাঁর স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ এবং তাদের ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্নবের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। প্রাথমিক অনুসন্ধানে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য পাওয়ায় দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত ওই আদেশ দেয়।
এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে দুদকে তলব করা হলেও হাজির না হয়ে “বেনজীর আহমেদের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্য দুদকে দেওয়া হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান খুরশিদ আলম খান।
সেই বক্তব্য পর্যালোচনা করে শিগগির “আইনি ব্যবস্থা” গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং সাবেক পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাঁদের দুর্নীতি নিয়ে যেসব অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তারপর এসব বিষয়ে অন্যান্যদের মতো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”