প্লট জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে মামলা
2021.10.07
ঢাকা
নিজের বড়ো ভাইকে একটি সরকারি প্লট পাইয়ে দিতে এবং পরবর্তীতে এর আকার বাড়িয়ে স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের’ অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে নতুন করে একটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের মামলায় বৃহস্পতিবার বলা হয়েছে, নিজের নামে একটি সরকারি প্লট থাকার পরও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল প্রকল্পে বড়ো ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে আরো তিন কাঠার একটি প্লট পেতে ভাইকে দিয়ে আবেদন করান এসকে সিনহা।
প্লটটি পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করেছেন এসকে সিনহা—এই অভিযোগে দায়ের করা এই মামলায় আরো বলা হয়, “তাঁর (এসকে সিনহা) নিজ নামে ইতোপূর্বে রাজউক হতে উত্তরা আবাসিক এলাকায় একটি প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে, তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ ক্ষমতা অপব্যবহার করে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয়ে তাঁর ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পে প্লটের জন্য আবেদন করান এবং তিন কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ করান।”
পরবর্তীতে “প্রভাব খাটিয়ে” ওই তিন কাঠার প্লটটিকে ৫ কাঠার প্লটে উন্নীত করে “পুনরায় নিজ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পূর্বাচল থেকে প্লট স্থানান্তর করে” রাজউক থেকে উত্তরায় প্লটটি অনুমোদন করান,” জানানো হয় মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর)।
অনুসন্ধানকালে দুদক জানতে পারে, ওই জমিতে একটি নয় তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় যার মূল্য ৭ কোটি টাকারও বেশি। বাড়িটির নির্মাণ ব্যয়ও বহন করেন সাবেক এই বিচারপতি। এমনকি এই টাকার কোনো বৈধ উৎস খুঁজে পায়নি দুদক।
“সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই উক্ত প্লটের যাবতীয় অর্থ পরিশোধ করেন। এরূপে তিনি নিজের ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে প্লট বরাদ্দ প্রাপ্তির পর উক্ত প্লটের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়োগ করেন জনৈক শংখজিৎ সিংহকে, যিনি জনাব এস, কে সিনহার গ্রামের আত্মীয়। শংখজিতকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এ কাজে নিয়োজিত করেন এবং তাঁকে বাড়ি নির্মাণ কাজের যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদনের জন্য নিয়োজিত রাখেন,” বলা হয় মামলার এজাহারে।
তবে এই মামলায় নরেন্দ্র সিনহা, শংখজিত, রাজউকের কোনো কর্মকর্তা বা অন্য কোনো সুবিধাভোগীকে আসামি করা হয়নি।
অন্য কাউকে কেন আসামি করা হয়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব ড. মু: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বেনারকে বলেন, “অনুসন্ধানে জানা গেছে নরেন্দ্র সিনহা এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। যা করার সব এসকে সিনহাই করেছেন। তবে তদন্তকালে যদি আর কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাঁদের এই মামলার অভিযোগপত্রে যুক্ত করা হবে।”
মামলার এজাহারের বিবরণ উল্লেখ করে দুদক সচিব বলেন, এসকে সিনহা “প্রতারণার মাধ্যমে নিজের ভাই ও আত্মীয়ের নামে সাত কোটি চৌদ্দ লাখ পাঁচ হাজার আটশত পঁয়ষট্টি টাকার সম্পদ অর্জন” ও “অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবের মাধ্যমে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর” করেছেন।
বড়ো ভাই নিজেই আবেদন করেছেন!
রাজউকের কাছ থেকে এই প্লটটি বরাদ্দ পাবার ক্ষেত্রে কিছু জানতেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে এসকে সিনহার বড়ো ভাই নরেন্দ্র সিনহা মৌলভীবাজার থেকে টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “রাজউকের প্লট বরাদ্দ চেয়ে আমার ছোট ভাইয়ের পরামর্শে আমি নিজেই আবেদন করেছি। এমনকি এ–সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রে আমি নিজেই স্বাক্ষর করেছি।”
তিনি বলেন, “রাজধানীর উত্তরায় পাঁচ কাঠা জমির উপর নির্মিত ৯ তলা ভবনটি এখনো আমার নামেই আছে। সেখানে আমার আত্মীয়–স্বজনরা থাকেন।”
দুদক বলছে তিনি কিছুই জানেন না—এটা কতটা ঠিক তা জানতে চাইলে নরেন্দ্র সিনহা বলেন, “এটা ঠিক না। আমি জেনে শুনেই সব করেছি। ছোট ভাই বলেছে, তাই সরল বিশ্বাসে সব কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছিলাম।”
তিনি জানান, এসকে সিনহা বর্তমানে কানাডায় আছেন এবং তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুল ইসলাম দুলু বেনারকে বলেন, “এটা সত্য যে আরো কেউ অপরাধী থাকলে তদন্তকালে তাদের মামলায় সম্পৃক্ত করার সুযোগ আছে। দুদক নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবে যাতে আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোনো প্রকৃত অপরাধী বাদ না পড়ে যায়।”
এদিকে গত ৫ অক্টোবর রায় হবার কথা থাকলেও, জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ঋণের চার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অপর একটি চলমান মামলার রায়ের জন্য আগামী ২১ অক্টোবর দিন ধার্য করেছে আদালত।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বসে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।