তিন মাসে কারাবন্দি ১৩ নেতার মৃত্যু, নির্যাতনের অভিযোগ বিএনপির
2024.02.09
ঢাকা
সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এলেও বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি কারাবন্দি নেতাকর্মীদের স্বজনরা নতুন করে সরকারের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলছেন।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সকালে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে গংগাচড়া উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়ন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলামের (৩৫) মৃত্যু হয়। তাঁর স্বজনদের অভিযোগ. হেফাজতে নির্যাতনের পরে বিনা চিকিৎসায় মনোয়ারুল মারা গেছেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত তিন মাসে দেশের কারাগারগুলোতে মনোয়ারুলসহ ১৩ নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মনোয়ারুলের বাবা ফজলে রহমান ও ছোট ভাই হারুন এবং তাঁর স্বজনরা জানিয়েছে, গত ১৩ জানুয়ারি সুস্থ-সবল মনোয়ারুলকে পুলিশ দিনের বেলায় বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়।
“সেদিন আদালতে চালান না দিয়ে পরের দিন রাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে বর্বরোচিত কায়দায় অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তার সমস্ত শরীরে, পায়ে, পিঠে ও মাথায় আঘাতের গভীর চিহ্ন দেখা গেছে। পুলিশ নির্যাতন চালিয়ে মনোয়ারুলকে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করেছে।”
মনোয়ারুলসহ কারা হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনায় “আন্তর্জাতিক তদন্তের” দাবি জানান রিজভী।
বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গংগাচড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “থানায় এনে কাউকে নির্যাতন করা হয়েছে এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। এমন অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া কিছু নয়।”
মনোয়ারুলকে নির্যাতন করার অভিযোগ “সত্য নয়” দাবি করে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বেনারকে বলেন, “কারাগারে বুকে ব্যথা অনুভব করলে মনোয়ারুলকে বৃহস্পতিবার ভোরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৭টার দিকে তিনি মারা যান।”
কারা সেলগুলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প: বিএনপি
গত তিন মাসে কারাগারে ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে’ বিএনপির ১৩ জন নেতা-কর্মীর মৃত্যু প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, “প্রত্যেকটি মৃত্যু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”
“কারা সেলগুলোকে একেকটি শ্বাসরুদ্ধকর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে,” অভিযোগ করে তিনি বলেন, প্রতিটি কারাগারে “কারাবিধির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে” বন্দি নেতা-কর্মীদের ওপর “বীভৎস নিপীড়ন” চালানো হচ্ছে।
বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয় আছে এমন বন্দিদের খাওয়ার কষ্ট দেওয়া হচ্ছে, চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, “কারা কর্মকর্তারা প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন।”
কারা হেফাজতে নির্যাতন ও সুবিধা না দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক বেনারকে বলেন, কারাগারে বন্দি নির্যাতনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
“দেশের প্রতিটি কারাগারেই জেল কোড অনুযায়ী বন্দি ও কয়েদিদের খাবার, পোশাক, চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে। কোনো বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে,” বলেন তিনি।
এর আগে বেনারের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, কারাগারে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। যারা অসুস্থ হয় তাদেরকে যথাযথ নিয়ম মেনেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
তিনি বলেন, “শুধু রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য বিএনপি নানা রকম অভিযোগ করে থাকে।”
গত বছরের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর পুলিশি ক্র্যাকডাউনে ২৫ হাজারে বেশি নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে দাবি করে আসছে বিএনপি।
গত সেপ্টেম্বর সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ৬৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৬৬, এর বিপরীতে মোট বন্দির সংখ্যা ৭৭ হাজার ২০৩।
পুলিশি অভিযানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ গ্রেপ্তার বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী কারাবন্দি।
বিরোধী নেতা-কর্মীদের মৃত্যু ‘উদ্বেগজনক’: আসক
গত ২৮ অক্টোবরের পর কারাবন্দি বিরোধী নেতা-কর্মীদের মৃত্যু ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে দেখছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
সংগঠনটি নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, কারাগারে সব বন্দির সঙ্গে একই আচরণ করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে তা অপ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন, “চিকিৎসা না পেয়ে বা নির্যাতনে মৃত্যুর যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সরকার এসব মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।”
কারা বা পুলিশ হেফাজতে বিএনপির ১৩ মৃত্যুর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন কারাগার, হাসপাতাল ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে বেনার কমপক্ষে ১২টি মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি নেতা গোলাপুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল, গাজীপুর জেলার আসাদুজ্জামান খান হিরো, রাজশাহী জেলার মনিরুল ইসলাম, নওগাঁ জেলার মতিবুল মন্ডল, গাজীপুরের কাপাসিয়ার মো. শফিউদ্দিন মাস্টার, ঢাকার মুগদা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান কাজল, খুলনা মহানগরের মো. কামাল হোসেন মিজান, ঢাকার দোহার উপজেলার মো. হারুন ও সাতক্ষীরার আব্দুস সাত্তার।