ডিবি হেফাজতে মৃত টেকনাফের সিদ্দিক ঢাকায় এসেছিলেন আদালতে হাজিরা দিতে: পরিবার

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2022.08.18
ঢাকা ও কক্সবাজার
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
ডিবি হেফাজতে মৃত টেকনাফের সিদ্দিক ঢাকায় এসেছিলেন আদালতে হাজিরা দিতে: পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন বিরোধী কর্মসূচি। ১৮ আগস্ট ২০২২।
[বেনারনিউজ]

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকাকালে বুধবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাওয়া সিদ্দিক আহাম্মেদ (৬২) পুরানো মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে রাজধানীতে এসেছিলেন বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার।

মৃতের সন্তান মোহাম্মদ ইসমাইল বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে বলেন, “পুরানো একটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গত মঙ্গলবার বাবা আমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় রওনা হন।”

“এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে খবর আসে ডিবির হেফাজতে বাবার মৃত্যু হয়েছে। তবে কী কারণে বাবা ডিবির হেফাজতে ছিলেন, তা আমি এখনো জানি না,” যোগ করেন তিনি।

ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) এরশাদ হোসেনের ভাষ্যানুযায়ী, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হ্নীলা ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের উলুচামারি গ্রামের সিদ্দিককে মঙ্গলবার রমনা এলাকা থেকে এক হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

“তাঁর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন এই কর্মকর্তা।

“জিজ্ঞাসাবাদে সিদ্দিক বলেছে, সে ঢাকায় একজনের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতে এসেছিল। তবে সে কার কাছে ইয়াবা দিতে এসেছিল, সে বিষয়ে মুখ খোলেনি,” যোগ করেন তিনি।

সিদ্দিককে বুধবার রাতে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন পুলিশের এসআই এরশাদ। এর আগে তাঁকে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তিনি পেটের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখান থেকে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে দাবি ডিবির এই কর্মকর্তার।

তিনি আরও জানান, চিকিৎসকেরা সিদ্দিককে হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। রাত নয়টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।

সিদ্দিকের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে উল্লেখ করে এসআই এরশাদ জানান, তার বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। লাশ নিতে তাঁর স্বজনেরা ঢাকায় রওনা হয়েছেন।

সিদ্দিকের ছেলে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বেনারকে জানান, তাঁরা কিছুক্ষণ আগে ঢাকায় পৌঁছেছেন। কোন মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে তাঁর বাবা ঢাকা এসেছিলেন জানতে চাইলে ইসমাইল বলেন, “মারামারির মামলায়।”

তবে হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী এবং ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল হোসেন বেনারকে জানান, এর আগে ইয়াবা পাচারের মামলাতেই কারাগারে ছিলেন ডিবি হেফাজতে মৃত সিদ্দিক।

চিকিৎসা নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটের সদ্য সমাপ্ত সফর উপলক্ষে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নিয়ে চলমান আলোচনা ও প্রতিবাদের মধ্যে এমন ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

“এ রকম একটি অবস্থায় যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে নানা ধরনের কথাবার্তা চলছে, ঠিক সেই সময়ে ডিবি হেফাজতে মৃত্যুর এই ঘটনা জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের আহবান জানাচ্ছি। যদি তাঁর মৃত্যু কারো অবহেলাজনিত কারণে বা নির্যাতনের জন্য হয়ে থাকে তবে জড়িতদের অবশ্যই চিহ্নিত করা দরকার,” বলেন তিনি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খানের মতে, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন কাউকে গ্রেপ্তার করে, তখন তাঁর অবস্থা যদি খারাপ মনে হয় বা তিনি যদি অসুস্থ বোধ করেন, সাথে সাথে চিকিৎসা নিশ্চিত করার বিষয়টি গ্রেপ্তার করা কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়।”

“এক্ষেত্রে সিদ্দিক কখন থেকে ডিবি হেফাজতে ছিলেন? তাঁকে কী ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে? তাঁর পরিবার ও আইনজীবীকে জানানো হয়েছিল কী?–এসব প্রশ্নের জবাব জানা জরুরি,” যোগ করেন তিনি।

সাত মাসে হেফাজতে ১১ মৃত্যু

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে আসক।

আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সাত মাসে গ্রেপ্তারের আগেই র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে দুজন।

গ্রেপ্তার দেখানোর আগে শারীরিক নির্যাতনের কারণে র‍্যাবের হেফাজতে একজন ও পুলিশের হেফাজতে দুইজন মারা গেছেন। একই কারণে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের হেফাজতে তিনজন নিহত হয়েছেন।

এছাড়া ওই সাত মাসে র‍্যাবের হেফাজতে ‘হার্ট-অ্যাটাকে’ একজন ও পুলিশের হেফাজতে অসুস্থ হয়ে আরো দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে উল্লেখ করে নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “ডিবি হেফাজতে মৃত্যুর এই ঘটনা তদন্তের দাবি রাখে। সাম্প্রতিক সফরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলে গেছেন,” বলেন তিনি।

নূর আরো বলেন, “দেশের মানবাধিকার কর্মীরাও এক দশকের বেশি সময় ধরে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার সেটাকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে এ কথা বলতে হলো।”

তাঁর প্রত্যাশা, সরকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করবে এবং প্রয়োজনে এ বিষয়ে জাতিসংঘের সহায়তা নেবে।

আসকের হিসেবে, বছরের প্রথম সাত মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন আরো ৪০ জন। যার মধ্যে ২৭ জন বিচারাধীন এবং ১৩ জন সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন।

ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আহাম্মদ ফয়েজ

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।