পুলিশ হেফাজতে চট্টগ্রামে সাবেক দুদক কর্মকর্তা ও বগুড়ায় আইনজীবীর সহকারীর মৃত্যু

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.10.04
ঢাকা
পুলিশ হেফাজতে চট্টগ্রামে সাবেক দুদক কর্মকর্তা ও বগুড়ায় আইনজীবীর সহকারীর মৃত্যু ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের মানববন্ধন। ১৪ জুলাই ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের আঙুল না সরতেই গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় পুলিশ হেফাজতে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।

মৃত ব্যক্তিদের স্বজনের অভিযোগ, নির্যাতনের কারণেই তাঁরা মারা গেছেন।

মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বগুড়ায় আইনজীবীর সহকারী হাবিবুর রহমান হাবিব (৪০) ও চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক উপপরিচালক সৈয়দ মো. শহীদুল্লাহ (৫৮) মারা যান।

তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ জানিয়েছে, অসুস্থতাজনিত কারণে দুই ব‌্যক্তি মারা গেছেন। তাঁদের কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আটকের সময় সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। দেশের আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে দায়ী কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে।

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাব ও সংস্থাটির সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

এর পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে আসে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো কথিত বন্দুকযুদ্ধকে নিছক হত‌্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করলেও সরকার বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। 

চট্টগ্রামে মৃত্যু

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার চাঁদগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ইসলাম বুধবার বেনারকে জানান, ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি মামলায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

সেই পরোয়ানা অনুসারে মঙ্গলবার রাতে দুই জন উপপরিদর্শক (এসআই) সাদা পোশাকে শহীদুল্লাহকে মহুরিবাজার এলাকা থেকে আটক করে নিয়ে আসেন জানিয়ে তিনি বলেন, “থানায় আনা হলে আমি তাঁকে আমার রুমে বসতে দিই। কিছুক্ষণ পর উনি বলেন যে, উনার খারাপ লাগছে। তখন আমরা তাঁর পরিবারের সদস‌্যদের খবর দেই।”

তিনি বলেন, “অ‌্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তাঁকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।”

“তাঁকে কোনো প্রকার নির্যাতন অথবা অসম্মান করা হয়নি,” জানিয়ে খায়রুল ইসলাম বলেন, সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে “নিয়ম মেনে” মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তবে শহীদুল্লাহর ভাতিজা সৈয়দ সাকিব আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, তাঁকে “একটি মিথ‌্যা মামলায়” পুলিশ রাত সাড়ে ১১টার দিকে “টেনে-হিঁচড়ে বাসা থেকে নিয়ে গেছে। থানায় নিয়ে তাঁকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “উনি ওষুধ সেবন করতেন। পুলিশ ওষুধও সেবন করার সুযোগ দেয়নি।”

এই ঘটনার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন সাকিব।

বগুড়ায় হেফাজতে মৃত্যু

বগুড়ায় নিহত হাবিবুর রহমানের মামা অ‌্যাডভোকেট মঞ্জুরুল হক বুধবার বেনারকে জানান, হাবিব তাঁর সঙ্গে আদালতে কাজ করতেন। মঙ্গলবার বিকেলে হাবিব এবং আরেকজন ফাইলপত্র নিয়ে রিকশায় বাসায় যাওয়ার পথে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস‌্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। হত‌্যার অভিযোগে হাবিবের বিরুদ্ধে একটি মিথ‌্যা মামলা রয়েছে, যেটির বিচারকাজ চলছে।

বগুড়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আখতার বেনারকে বলেন, মৃত হাবিব ২০১৩ সালে ১৫ বছরের একটি ছেলেকে অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।

তিনি বলেন, ওই মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন খুকি বেগম। তিনি আগস্ট মাসে নিহত হন এবং তাঁর গলিত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। খুকি বেগম হত্যার তদন্তে মনোয়ারা নামের এক নারী স্বীকারোক্তি দিয়ে খুকি বেগম হত্যার সাথে হাবিবের সংশ্লিষ্টতা জানান।

স্নিগ্ধ আখতার বলেন, “আমরা হাবিবকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আরেক আসামি মনোয়ারা বেগমের স্বীকারোক্তির কথা জানাতেই সে বিচলিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।”

“হাবিবকে কোনো প্রকার নির্যাতন করা হয়নি,” দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা তাঁকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানেই তিনি মারা যান। তাঁর শরীরে কোন প্রকার নির্যাতনের চিহ্ন নেই।”

মঞ্জুরুল হকের মতে, “একজন সুস্থ মানুষ আমার অফিস থেকে বাসায় গেল, আর একজন মানুষকে দেখেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল! এটা কি বিশ্বাসযোগ‌্য কথা! পুলিশ তাঁকে নির্যাতন করে হত‌্যা করেছে।”

এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে আইনগত ব‌্যবস্থা নেবেন বলেও জানান মঞ্জুরুল।

পুলিশের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়

অনেককে আটক করে থানায় নেওয়ার পরে “বুকে ব‌্যথ‌া হয়ে মৃত‌্যুবরণ করছেন অথবা থানায় আনার পর অচেতন হয়ে পড়ছেন; হাসপাতালে নেওয়ার পর মানুষ মারা যাচ্ছেন,” পুলিশের এমন ব্যাখ্যা “গ্রহণযোগ্য” নয় বলে মনে করেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান।

তার মতে, “এ ধরনের মৃত‌্যুর জন‌্য পুলিশ দায়ী।”

“পুলিশ যা কিছুই বলুক না কেন, ঘটনা দু’টি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু,” বেনারকে বলেন নূর খান।

বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত‌্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক আটককালে কোনো ব‌্যক্তির মৃত‌্যু হলে অথবা জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোনো মানুষ মৃত‌্যুবরণ করলেও হেফাজতে মৃত‌্যুর অন্তর্ভুক্ত হবে।”

হেফাজতে মৃত‌্যুর সাজা পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান তিনি।

এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ আটকের আগে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে; জোর করে, টেনে-হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়। ফলে অনেক মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন; এটিই স্বাভাবিক। এ জন‌্য পুলিশই দায়ী।”

“আইনের মধ‌্যে থেকে দায়িত্ব পা‌লনের মাধ‌্যমে পুলিশের এই আতঙ্কের ভাবমূর্তি দূর করতে হবে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সাদা পোশাকে সব ক্ষেত্রেই আটক করা যাবে না। বগুড়া ও চট্টগ্রামের ঘটনা দু’টির সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব‌্যক্তি ও তাদের সহযোগীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”

এদিকে পুলিশ হেফাজতে ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে তিন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল চার, ২০২০ সালে ছিল ১১।

তবে এখন পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগের বিচার হয়েছে মাত্র একটি। 

মিরপুর-১১ নম্বর সেক্টর থেকে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইশতিয়াক হোসেন জনি নামে এক যুবককে আটক করে পল্লবী থানায় পুলিশ। জনিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে আদালতে মামলা দায়ের করেন তাঁর ভাই। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সেই মামলার রায়ে আদালত ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

২০১৩ সালে পাস হওয়া এই আইনের আওতায় এটিই ছিল প্রথম সাজা।

মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।