গোয়েন্দা পুলিশের নতুন ইউনিফর্ম, লক্ষ্য ডিবি পরিচয়ে অপরাধ ঠেকানো

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.08.01
ঢাকা
গোয়েন্দা পুলিশের নতুন ইউনিফর্ম, লক্ষ্য ডিবি পরিচয়ে অপরাধ ঠেকানো কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোডযুক্ত নতুন পোশাক পরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। ১ আগস্ট ২০২২।
[সৌজন্যে: ডিবি]

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পরিচয় দিয়ে অপরাধ ঠেকাতে নতুন পোশাক চালু করেছে সংস্থাটি।

ছাই রংয়ের নতুন এই পোশাকে রয়েছে কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড যা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্ক্যান করলেই আসামি ধরতে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় জানা যাবে। পুরানো পোশাকের রং কিছুটা পিত রংয়ের এবং পেছনে ডিবি লেখা।

সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন পোশাক ব্যবহারের বিষয়টি জানান ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

সংবাদ সম্মেলনের আগে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে ডিবি পরিচয়ে ডাকাতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছয় ডাকাতকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।

রোববার টয়েনবি সার্কুলার রোড এলাকা থেকে আটক এই ছয় অভিযুক্ত ডাকাতরা হচ্ছেন- ফরিদ উদ্দিন, পারভেজ, সাইফুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, জসিম ও নাছির।

‘পোশাক বদলে কাজ হবে না’

তবে মানবাধিকার কর্মী এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধ ঠেকাতে পোশাক পরিবর্তন কোনো কাজে আসবে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান সোমবার বেনারকে বলেন, “ভুয়া ডিবি পরিচয়ে অপরাধ বন্ধ করতে ডিবি পোশাক পরিবর্তনের যে কথা জানিয়েছে সেটি আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। তারা যাকে খুশি তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, আটক রেখেছে, হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে—এগুলো আমরা দেখেছি।”

তিনি বলেন, “তারা আটকের সময় কাউকে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। এভাবে তারা সারাদেশে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সে কারণে অপরাধী ডিবি ব্র্যান্ড ব্যবহার করার কৌশল অবলম্বন করেছে।”

নূর খান বলেন, “ভুয়া ডিবি সদস্যদের কথা বলে ডিবি তাদের অতীত এবং বর্তমান কৃত অপকর্মের দায় তাদের ওপর চাপাতে চাইছে। তারা বলতে চাচ্ছে, ‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি’।”

তিনি বলেন, “এগুলো না করে উচিত, তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যারা ডিবির নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করেছে তাদের সংস্থাটি থেকে বের করে দেওয়া হোক।”

নূর খান বলেন, “ডিবি বলছে, নতুন পোশাকে কিউআর কোড থাকবে এবং মানুষ অ্যাপের মাধ্যমে আসামি ধরতে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় জানতে পারবেন। এটি একটি অবাস্তব ধারণা। ডিবির সদস্যরা যখন কাউকে ধরতে যায় তারা কাউকে তোয়াক্কা না করে জোর করে মানুষকে ধরে নিয়ে আসে। ওই অবস্থায় কারো পক্ষে কি অ্যাপের মাধ্যমে কিউআর কোড ব্যবহার করা সম্ভব?”

তিনি বলেন, “র‌্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির পর এখন পুলিশ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা চাপা দিতে বিভিন্ন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এটি সেই কৌশলের একটি অংশ বলে আমি মনে করি।”

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ. কে. এম শহীদুল হকও পোশাক পরিবর্তনকে সমর্থন করছেন না। তিনি জানান, পুলিশ কাউকে গুম করে না, তবে ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক করে এবং পরে মামলা দায়ের করে।

তাঁর মতে, “অপরাধ দমন ও বিচারের স্বার্থেই বিনা ওয়ারেন্টে আসামিদের আটক করা হয়। যখন দেখা যায়, কোনো অপরাধী অপরাধ করে পালিয়ে যেতে পারে, তখন তাকে আগে আটক করে পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।”

সাবেক এই মহাপরিদর্শক বলেন, “ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করার বিষয়টি আইনসিদ্ধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুসারে, সন্দেহ হলে অথবা ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কাউকে আটক করতে পারে পুলিশ। পৃথিবীর সব দেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এমন ক্ষমতা রাখে।”

“তবে এই ক্ষমতার অপব্যবহারও হয়, যা বন্ধ করতে হবে। কেউ যেন ডিবি অথবা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে অপরাধ না করতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

শহীদুল হক আরও বলেন, “ডিবির পোশাক পরিবর্তন সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো, এটা করে আসলে লাভ হবে না। অপরাধীরা ঠিকই নতুন পোশাকের আদলে পোশাক বানিয়ে ফেলবে। ওরা অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের চেয়ে এগিয়ে।”

তিনি বলেন, “আমি মনে করি, কাউকে আটক করতে গেলে ডিবির সদস্যদের অবশ্যই পরিচয়পত্র দেখাতে হবে এবং কেউ পরিচয়পত্র না দেখাতে চাইলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করলে প্রতিকার পাওয়া যাবে।”

‘সমস্যা পোশাকে নয়’

ভুয়া ডিবির অপরাধ ঠেকাতে পোশাক পরিবর্তনের ধারণাকে “স্থূল বুদ্ধির পরিচয়” হিসাবে আখ্যায়িত করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ অপরাধ করার কারণে সবাই যদি পোশাক পরিবর্তন করা শুরু করে তাহলে তো মুশকিল।”

তিনি বলেন, “সমস্যা পোশাকে নয়। সত্য কথা বলতে কি, ডিবির ভেতরে সমস্যা না থাকলে এত সংখ্যক ভুয়া ডিবি সদস্য দেখা যেত না। ডিবির সদস্যদের সমস্যার কারণেই ভুয়া ডিবি এসেছে।”

অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা হরহামেশা ভুয়া পুলিশ, ভুয়া ডিবি দেখতে পাই। ভুয়া সেনা সদস্য কিন্তু খুব কম দেখা যায়। এর কারণ কোনো ভুয়া সেনা সদস্য ধরা পড়লে সেনা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যেভাবে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয় সেটি দেখে অন্যরা এমন অপরাধে জড়াতে সাহস পায় না।”

তিনি বলেন, “ডিবি সদস্যরা হরহামেশা যে কোনো মানুষকে তুলে নিয়ে যায়। ধরার পর স্বীকার করে না। এগুলো তো আমরা দেখছি। এগুলো বন্ধ করতে হবে।”

অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “সুতরাং, নিজেদের দুর্বলতা না কাটিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে কিছু হবে না। এই পোশাক পরিবর্তনের কারণে পোশাক সরবরাহকারী ঠিকাদার এবং তাদের কাছের কিছু লোকজন আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এর বাইরে আর কিছু হবে বলে মনে হয় না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।