গবেষণা প্রতিবেদন: প্রতিটি মৃত্যুদণ্ড একেকটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে

আহম্মদ ফয়েজ
2021.06.21
ঢাকা
গবেষণা প্রতিবেদন: প্রতিটি মৃত্যুদণ্ড একেকটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ। ২০ মে ২০২১।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

কেউ মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাবার পর তাঁর পরিবারকেও চরম সামাজিক, মানসিক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় বলে জানিয়েছে এক সাম্প্রতিক গবেষণা। আর সেই পরিবার যদি হয় দরিদ্র, তবে তাঁদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

গবেষণায়, ২৩ বছর বয়সে গ্রেপ্তার হয়ে বিচার শেষে এখন দণ্ড কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন এমন এক যুবকের ঘটনা তুলে ধরা বলা হয়, বাইরে তাঁর একমাত্র সন্তান ও স্ত্রী পার করছেন কঠিন সময়।

পাঁচ বছর বয়সের ছেলে এবং স্ত্রীকে রেখে গ্রেপ্তার হবার কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁর বাড়িঘর ভাংচুর করে। কৃষি নির্ভর ব্যবসা করা ওই যুবকের সঞ্চয় দ্রুত শেষ হয়ে যায়। শেষে স্বামী জেলে যাওয়ার পাঁচ বছর পর একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি নেন স্ত্রী। সেখানেই গত দুই বছর কাজ করছেন। 

এর মাঝে স্বামীর জন্য আইনি লড়াইয়ে ছয় লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে সম্পত্তি বন্ধক রেখে সুদে টাকা নিয়েছেন তিনি। অর্থাভাবে তিনি এখন আর জেলে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখাও করতে পারেন না।

ওই পরিবারের এই দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও দ্য ডেথ পেনাল্টি প্রজেক্টের সহযোগিতায় পরিচালিত একটি গবেষণায়, যা গত বৃহস্পতিবার একটি ওয়েবিনারে প্রকাশ করা হয়।

২০১৩ সালে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৯ জনকে নিয়ে এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। গবেষণার নীতিমালা অনুযায়ী কোনো আসামি বা তাঁদের পরিবার সদস্যদের নাম পরিচয় প্রকাশ করেননি গবেষকরা।

এক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করার অভিযোগ গ্রেপ্তার হওয়া ১৯ বছর বয়সের আরেক তরুণের ঘটনা গবেষণায় তুলে ধরা হয়। ওই ঘটনার পর তাঁকে পিটিয়ে অচেতন অবস্থায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে গ্রামবাসী। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ওই তরুণকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। একই আদেশ বহাল থাকে উচ্চ আদালতেও।

ওই তরুণ গ্রেপ্তার হবার পরপরই স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তরুণের পরিবারকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, দখল করে জমি। উপার্জনের সব উৎস হারিয়ে পরিবারটি এখন অন্য এক পরিবারে আশ্রিত অবস্থায় রয়েছে।

ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে জেলে থাকা আরেক আসামির ভাই গবেষকদের বলেন, তাঁর পরিবার এখন ঋণগ্রস্ত এবং আর্থিকভাবে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

“মৃত্যুদণ্ডের রায় হবার পর শোকে আমার বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন। ভাইয়ের স্ত্রীও তাকে ছেড়ে গেছে। লোক লজ্জায় আমি ঢাকায় এসে একটি দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করছি,” বলেন তিনি।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়াদের বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ

শুধু এই তিনটি পরিবার নয়, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্য থেকে ৩৯টি মামলা নিয়ে তাঁদের অথবা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল। তাঁরা ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গবেষণাটি সম্পন্ন করে সংক্ষিপ্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেন।

“আমরা চেষ্টা করেছি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বা দণ্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া আসামিদের পরিবারগুলো কী ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, সেই চিত্র তুলে আনতে,” বেনারকে বলেন অধ্যাপক মাহবুব।

গবেষণা ফলাফলের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, দেশে গত দুই দশকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান এবং দণ্ড কার্যকরের সংখ্যা বেড়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বেশিরভাগ দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণিভুক্ত।

মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের বেশির ভাগ কেন দরিদ্র মানুষ, এমন প্রশ্নের জবাবে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হক বেনারকে বলেন, “দরিদ্র মানুষ সব সময় আইনের যথাযথ সুবিধা পান না। তাঁরা তাঁদের আর্থিক সংকটের কারণে উপযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ করে সঠিক আইনি সুরক্ষা নিতে পারেন না।”

“বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি অর্থের অভাবে আইনজীবী নিয়োগে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র উক্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী দিয়ে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় এসব আইনজীবীরা দক্ষ হন না, বা সংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনায় আন্তরিক থাকেন না,” বলেন বিচারপতি নিজামুল।

তিনি বলেন, কিছু মানুষ মনে করেন মৃত্যুদণ্ড অবৈধ কাজ বা অপরাধ কমায়। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। এই বিধান থাকলেও অপরাধ হয়, না থাকলেও হয়।

বাংলাদেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ফাঁসির দাবি তোলার প্রবণতাকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে উল্লেখ করে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আনতে সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন।

গবেষণা দলের সদস্য ও ব্লাস্টের অ্যাডভোকেসি উপদেষ্টা তাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ভালো আইনজীবীদের ফি অনেক। সাধারণত দরিদ্র মানুষ ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে না। মামলায় হেরে যাওয়ার এটি একটি বড়ো কারণ।”

তিনি আরও বলেন, এর বাইরেও একটি মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নানা পর্যায়েই অর্থের প্রয়োজন পড়ে, যা দেবার সক্ষমতা না থাকে না অনেক দরিদ্র ব্যক্তির। 

গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিশ্বের ১০৮টি দেশে বিলুপ্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা কার্যকরে অনেক সময় লাগে। ১৫-২০ বছর পর্যন্ত দণ্ডিত ব্যক্তিকে এ জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এটি তাঁর জন্য বাড়তি শাস্তি হয়ে যায়। মৃত্যুদণ্ডের বিধান পরিবর্তনের বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে “প্রতিটি মানুষের সমান আইনি সুরক্ষা পাবার অধিকার রয়েছে এবং সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক,” জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “দরিদ্র বলে কাউকে বেশি সাজা দেওয়া হয় না। সাজা দেওয়া হয় অপরাধ বিবেচনায়।”

তিনি বলেন, “কোনো ব্যক্তি আর্থিক সক্ষমতার অভাবে আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারলে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আইনজীবী দেয়া হয়। এটা করা হয় এই উদ্দেশ্যেই, যাতে কেউ আইনের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন।”

“মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করার বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো পরিকল্পনা নেই,” জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, “তবে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার উপযোগী আসামিদের অনেক সময় সার্বিক দিক বিবেচনা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে থাকেন আমাদের বিচারকেরা।”

তিনি বলেন, বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড কমে আসলেও বাংলাদেশের এখনই সেই পথে হাঁটার সুযোগ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন হয়, সেগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না রাখার বিষয়ে চেষ্টা করা হয়। 

মামলা নিষ্পত্তি হতে লাগে দীর্ঘ সময়

কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া বেনারকে জানান, সারা দেশের কারাগারগুলোতে সোমবার পর্যন্ত বন্দি থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ২০০২। এর মধ্যে পুরুষ এক হাজার ১৪৮ এবং নারী ৫৪ জন।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কারাগারে বন্দি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ৫৩ শতাংশই স্বল্প বেতনের কাজ করতেন অথবা বেকার ছিলেন। তাঁদের ৭২ শতাংশকে ‘অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল’ শ্রেণিভুক্ত হিসাবে উল্লেখ করে গবেষণায় জানানো হয়, বন্দিদের কেউই মধ্য বা উচ্চবিত্ত শ্রেণির নয়।

এতে বলা হয়, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ জন, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৫৭ জন এবং ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।

গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে ঘটনার তারিখ থেকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি হতে ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। হাইকোর্ট বিভাগে মামলা নিষ্পত্তি হতে লেগেছে গড়ে সাড়ে পাঁচ বছর সময়।

বাংলাদেশের সাধারণ আইনে ৩৩টি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এর মধ্যে ১৪টি বিধান ২০০০ সালের পর যুক্ত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।