বাংলাদেশে এক সপ্তাহে ৪৫ আসামিকে ফাঁসির আদেশ, যাবজ্জীবন ৪৭

জেসমিন পাপড়ি
2021.12.09
ঢাকা
বাংলাদেশে এক সপ্তাহে ৪৫ আসামিকে ফাঁসির আদেশ, যাবজ্জীবন ৪৭ রাজশাহীতে আট বছর আগে ছাত্রলীগ নেতা ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী শাহিন আলম হত্যা মামলায় রায়ের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ০৯ ডিসেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

আট বছর আগে রাজশাহীতে ছাত্রলীগ নেতা ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী শাহিন আলম হত্যা মামলায় বৃহস্পতিবার সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলরসহ নয়জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ২২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

একই দিনে জয়পুরহাটে ১৪ বছর আগে জমি নিয়ে বিরোধের মামলায় এক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে নিহতের দুই ভাইসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

এই নিয়ে গত এক সপ্তাহে (২-৯ ডিসেম্বর) আলোচিত বিভিন্ন মামালায় অন্তত ৪৫ জনের ফাঁসি এবং ৪৭ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় এলো।

এর আগে বুধবার (৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।

গত ২ ডিসেম্বর ১০ বছর আগে রাজধানীর অদূরে সাভারের আমিনবাজারে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

একই দিন গাইবান্ধায় স্ত্রীকে হত্যার দায়ে মাইদুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

তবে নিম্ন আদালতের ফাঁসির আদেশই চূড়ান্ত নয়। দণ্ডপ্রাপ্তরা এরপর হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন। সেখানেও রায় বিপক্ষে গেলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের সুযোগ পেয়ে থাকেন। আপিল বিভাগেও ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকলে রায় কার্যকর করা হয়।

মৃত্যুদণ্ডের বেশিরভাগই উচ্চ আদালতে টেকে না

“আমি মনে করি, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবের কারণেই নিম্ন আদালতে গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। যে বা যারা আইনের বিধান প্রয়োগ করছেন তাঁদের বিচারিক মনোভাব যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে না পারা একটি বড়ো কারণ,” বেনারকে বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির।

তিনি বলেন, “বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের বেশিরভাগই উচ্চ আদালতে টেকে না। এখান থেকেই বোঝা যায় তা যথাযথ ছিল না। তাই আরো বিচার বিশ্লেষণ করে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।”

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নীনা গোস্বামী বেনারকে বলেন, “মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমরা কখনোই মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করি না। দেশের আইনে ৩৩ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আছে। তবে এর পাশাপাশি সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। আদালত সেটাও দিতে পারে।”

মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো অপরাধ ঘটলেই মানুষের মধ্যে ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই–দাবি ওঠে। মানে ফাঁসির আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। কারণ, অপরাধের ধরন যেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, মানুষের মধ্যে প্রতিশোধ প্রবণতাও তেমন বাড়ছে।”

“অবকাশ থাকা সত্ত্বেও আগে খুব কম সংখ্যক ফাঁসির আদেশ শোনা যেত। এখন অপরাধগুলোর চর্চা এমন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আসছে যে, সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই আশঙ্কাজনক,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) যৌথ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় তিন দশকে দেশে ১০১ জনের ফাঁসি (মৃত্যুদণ্ড) কার্যকর হয়েছে। গত বছরের জুনে এই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।

এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ জন এবং ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৫৭ জন ও ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৩ জন সাজাপ্রাপ্তের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।

সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চুয়াডাঙ্গার আলোচিত দুই গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

কনডেম সেলে দুই সহস্রাধিক কয়েদি

কারা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী (১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত) বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির (কয়েদি) সংখ্যা মোট এক হাজার ৯৮৭ জন। এর মধ্যে এক হাজার ৯৩৩ জন পুরুষ ও ৫৪ জন নারী।

তবে সেপ্টেম্বরের পর আরও প্রায় ১০০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে গত এক সপ্তাহে এমন দণ্ড পেয়েছেন ৪৫ জন।

সাধারণত, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেম সেলে আলাদা করে রাখা হয়। কারা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের সকল কারাগারে কয়েদিদের ব্যবহারের জন্য ২ হাজার ৫৯৯টি কনডেম সেল আছে। এরমধ্যে দুই হাজার ৪৫৬টি পুরুষ কয়েদিদের জন্য এবং ১৪৩টি নারী কয়েদিদের জন্য।

শাহিন হত্যার রায়: ১৪ বার তারিখ পরিবর্তন

রাজশাহীতে ছাত্রলীগ নেতা শাহিন হত্যা মামলার রায়ের তারিখ ১৪ বার পরিবর্তন করা হয় বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষে কৌঁসুলি (পিপি) মুসাব্বিরুল ইসলাম।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “অবশেষে বৃহস্পতিবার ১৫তম দিনে রায় ঘোষণা করা হল। এ হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত বলে আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে।”

নিহত শাহিন আলম রাজশাহী কোর্ট কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী ছিলেন। তিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজব আলীর ছোট ভাই।

মামলার নথির বরাতে পিপি মুসাব্বিরুল ইসলাম জানান, ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট শাহিন আলমকে হত্যা করা হয়।

ঘটনার পরদিন তাঁর ভাই নাহিদ আক্তার নাহান বাদী হয়ে রাজপাড়া থানায় মামলা করলে রাজশাহী সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর মনসুর রহমানসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত বছর ১১ নভেম্বর আদালতে এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১৮ জন ও আসামিপক্ষের চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে আদালত।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বাদী নাহান বলেন, “রায়ে আমরা খুশি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন সরকারের কাছে আবেদন, যেন দ্রুত রায় কার্যকর করা হয়।”

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “ঘটনার তথ্য-প্রমাণে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ঘটনাস্থলেও হত্যার কোনো আলামত নেই। এ অবস্থায় এ মামলায় সাজা হওয়া আশাব্যঞ্জক নয়। আমরা ব্যথিত, দুঃখিত। আমরা এর বিরুদ্ধে আপিল করব।”

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে মনসুর রহমান রাজশাহী সিটির সাবেক কাউন্সিলর। অন্যরা হলেন হাসানুল জামান হিমেল, তৌফিকুল ইসলাম চাঁদ, মোহাম্মদ মহাসিন, সাইরুল, রজব, বিপ্লব, মোমিন ও আরিফুল ইসলাম।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন মাহাবুল হোসেন, সাত্তার, সাজ্জাদ হোসেন, বখতিয়ার আলম রানা, হাসান আলী, মাসুদ, রাসেল, রাজা, মতুর্জা, সুমন, আসাদুল, আক্তারুল, জইদুর রহমান, ফরমান আলী, জয়নাল আবেদীন, রাজু আহমেদ, আকবর আলী, সম্রাট হোসেন, লাল মোহাম্মদ, টিয়া আলম, আজাদ হোসেন ও মাসুম।

রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ও এইচ এম ইলিয়াস হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় আসামিদের সবাই আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।