ডেঙ্গুর কারণে স্যালাইন সংকট, আমদানি করবে সরকার
2023.08.14
ঢাকা

বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত স্যালাইন না থাকায় বিপাকে পড়েছেন ডেঙ্গু রোগীরা। এর প্রেক্ষিতে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে স্যালাইন উৎপাদন বাড়াতে বলার পাশাপাশি বিদেশ থেকেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কোম্পানিগুলো ওষুধের দোকানে স্যালাইন সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু রোগীরা। কারণ কোম্পানিগুলো কেবলমাত্র হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্যালাইন সরবরাহ করছে।
“বর্তমানে সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইনের কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সে কারণে সরকার স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমদানি শুরু হতে কিছুটা সময় লাগবে,” বেনারকে বলেন মোহাম্মদ ইউসুফ।
উল্লেখ্য, গত মাস থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ‘ইনডেমিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “দেশে স্যালাইনের সংকট চলছে। কিটের সংকট রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ‘ইনডেমিক’ বলছে।”
তিনি বলেন, সংক্রমণ শতকরা পাঁচ শতাংশ হলে মহামারি বলা হতো। এনডেমিকের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। তবে বিষয়টিকে আমাদের সিরিয়াসলি নিতে হবে।”
বেড়েছে স্যালাইনের চাহিদা
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুল আলম সোমবার বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গুর কারণে দেশে স্যালাইনের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণে আমরা বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে তিন শিফটে উৎপাদন করে স্যালাইনের সরবরাহ বৃদ্ধির কথা বলেছি।”
“স্বাভাবিক সময়ে আমাদের কোম্পানিগুলো প্রতিদিন ৪০ হাজার প্যাকেট স্যালাইন উৎপাদন করে থাকে। বর্তমানে তারা তিন শিফটে কাজ করে প্রতিদিন এক লাখ ২০ হাজার প্যাকেট স্যালাইন উৎপাদন করছে। এরপরও ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথের সাবেক প্রধান ড. আবু বক্কর সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে কয়েকটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন তৈরি করে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হিসাবে, স্বাভাবিক সময়ে তারা বছরে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকার স্যালাইন তৈরি করে থাকে।”
“ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। কোম্পানিগুলো স্যালাইনের দাম না বাড়ালেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে ৫০ টাকার স্যালাইন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে,” বলেন তিনি।
বেসরকারি উদ্যোক্তা ফাতেমা আবেদিন নাজলা বেনারকে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর ১০ বছর বয়সী ভাতিজা লাবিব ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।
লাবিবকে প্রথমে হেলথ অ্যান্ড হোপ নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সে সময় লাবিবের রক্তচাপ আশঙ্কাজনকভাবে নেমে এসেছিল।
নাজলা বলেন, “হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা জানান যে, লাবিবকে স্যালাইন দিতে হবে। কিন্তু তাঁদের কাছে স্যালাইন নেই। তখন বাজে রাত ১২টা। আমি শমরিতা হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, বিআরবি হাসপাতাল, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে গিয়েছি। আশেপাশের সব ওষুধের দোকানে স্যালাইন খুঁজেছি—কোথাও পাচ্ছিলাম না। এদিকে ডাক্তাররা হাসপাতাল থেকে বারবার আমাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে স্যালাইন আনতে বলছিলেন।”
“স্কয়ার হাসপাতালের একজন কর্মী আমাকে একটি ওষুধের দোকান ও সেখানকার একজন কর্মচারীর নাম জানিয়ে বলেন, আমি যেন সেখানে গিয়ে নিচু স্বরে স্যালাইন চাই। তাহলে উনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন,” বলেন নাজলা।
তিনি আরও বলেন, “আমি সেখানে গিয়ে স্যালাইন চাইলে আমাকে ৫০০ মিলিলিটারের পরিবর্তে এক হাজার মিলিলিটারের একটি প্যাকেট দেন, যার অর্ধেকটি লাবিবের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।”
মিরপুর-১২ এলাকার ওষুধের দোকানের সত্ত্বাধিকারী মো. আসাদ বেনারকে বলেন, “আমরা স্যালাইনের জন্য বারবার তাগিদ দিলেও কোম্পানিগুলো আমাদের দিচ্ছে না। তাদের বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, কোম্পানিগুলো কেবলমাত্র হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্যালাইন সরবরাহ করছে। ফলে যাঁরা বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, হাসপাতালে যাচ্ছেন না, তাঁরা স্যালাইন পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি বেশ খারাপ।”
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “দেশের জনসংখ্যার বিপরীতে প্রতি বছর সাধারণত কত মানুষ অসুস্থ হয়ে থাকেন এবং তাঁদের কত জনের জন্য স্যালাইন প্রয়োজন সেটির একটি হিসাব থাকে। কোনো কারণে যদি সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সে ক্ষেত্রে স্যালাইনের সংকট হবে এটিই স্বাভাবিক। বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।”
ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য স্যালাইন কেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার অন্যতম শর্ত হলো রোগীর শরীরে পানির পরিমাণ ঠিক রাখা। এর একটি উপায় হলো মুখে খাবার স্যালাইন খাওয়ানো। তবে যাঁদের শরীরে ইতোমধ্যে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তাঁদের শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয়।”
লেলিন চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রবণতা যেমন দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আগামী অক্টোবর পর্যন্ত চলতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্যালাইন সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। এই সংকট মোকাবিলা করতে হলে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোকে আরও বেশি স্যালাইন প্রস্তুত করার তাগিদ দিতে হবে।”
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৪০০ ছাড়াল
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৮ জন মারা গেছেন। একই সময়ে আরও দুই হাজার ৪৮০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট ৪১৬ জনের মৃত্যু হলো।
সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে।
এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৮৭ হাজার ৮৯১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪৩ হাজার ৬৬৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮১ এবং মোট ৪০ হাজার ৭৬৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্বেগ
চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা ও হার গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা—ডাব্লিউএইচও। এ জন্য মশার বংশবিস্তারে দেশের অনুকূল পরিবেশকে দায়ী করেছে সংস্থাটি।
গত শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ডাব্লিউএইচও এডিস মশার প্রজনন স্থান ধ্বংস ও মশা রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে ফুল হাতার জামা পরার আহবান জানিয়ে সংস্থাটি বলছে, ডেঙ্গু মশার বিস্তার কমাতে যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের মূল্যায়নে বলেছে, বাংলাদেশ ডেঙ্গু ‘উচ্চ’ ঝুঁকিতে রয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি এবং ব্যাপক ভৌগোলিক বিস্তৃতির কারণেই সংস্থাটি এমন মূল্যায়ন দিয়েছে।