ডেঙ্গুতে মৃত্যু রেকর্ড ভেঙেছে, পরিস্থিতি ভয়াবহ বলছেন বিশেষজ্ঞরা

আহম্মদ ফয়েজ
2022.11.08
ঢাকা
ডেঙ্গুতে মৃত্যু রেকর্ড ভেঙেছে, পরিস্থিতি ভয়াবহ বলছেন বিশেষজ্ঞরা ঢাকার একটি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের সাথে অভিভাবকেরা। ১৯ অক্টোবর ২০২২।
[এএফপি]

দেশে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজনের মৃত্যুর পর চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮২ জন, যা দেশের ইতিহাসে বার্ষিক সর্বোচ্চ।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গু জ্বর শুরু হয়। ছে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ১৭৯।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে সারা দেশে নতুন করে ৮২০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৩ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্যমতে, ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৯৩ জন। এর পর কয়েক বছর এই সংখ্যা কিছুটা ওঠানামা করতে থাকলেও ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য থেকে সর্বোচ্চ দুই পর্যন্ত হয়।

২০১৫ সাল থেকে আবারও বাড়তে শুরু করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে এসে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৯ জনে। পরের বছর প্রকোপ কমে আসলেও ২০২১ সালে এসে আবার বাড়তে শুরু করে ডেঙ্গুর বিস্তার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের বুলেটিনে বলা হয়েছে, চলতি বছর সারা দেশে এখন পর্যন্ত এই রোগ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪৪ হাজার ৮০২।

২০১৯ সালে, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪।

পরিস্থিতি ভয়াবহ: বিশেষজ্ঞ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে এবং অক্টোবরে কমে আসে। কিন্তু এবার নভেম্বর মাসে এসেও যে হারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তা ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তাতে এটাকে মহামারি না বলা গেলেও ভয়াবহ বলতেই হচ্ছে।”

তিনি বলেন, অন্যান্য বছরগুলোতে এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসলেও এবার তা হয়নি।

“ডেঙ্গু মোকাবেলায় একটি জাতীয় কৌশল দরকার, সেটা এখনো হয়নি। মশার বিস্তার ঠেকাতে সাফল্য পায়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ, মানুষের মধ্যেও প্রয়োজনীয় সচেতনতা গড়ে ওঠেনি,” যোগ করেন তিনি।

তাঁর মতে, সরকারি পরিসংখ্যান থেকে বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ অনেকে এখনও সরকারি নজরদারির বাইরে থাকতে পারেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বেনারকে বলেন, অল্প কথায় বলা যায় পরিস্থিতি ভালো নয়।

“বিগত বছরের মতো এবারও ডেঙ্গু পুরোপুরি যাবে না। এখন থেকে, এটি সারা বছর ধরে থাকবে,” মনে করেন এই গবেষক।

নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অব্যাহত থাকার জন্য কবিরুল জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণকে দায়ী করেন।

“জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এ ছাড়াও, আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়নও দীর্ঘায়িত প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী,” যোগ করেন তিনি।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৯ রোহিঙ্গার মৃত্যু

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। চলতি বছরের ২ নভেম্বর পর্যন্ত শরণার্থী শিবিরের বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৯ জন।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এর কার্যালয়ের সহকারী স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী মো. সারওয়ার জাহান বেনারকে বলেন, এ বছর ১৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, ১৯ রোহিঙ্গা ছাড়াও শরণার্থী শিবিরে কর্মরত তিন উন্নয়নকর্মীও ডেঙ্গুতে মারা গেছেন।

ঘনবসতি ও কিছুটা অসচেতনতার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

যে কারণে মৃত্যু বেশি

এ বছর অধিক মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর নতুন ধরনকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ইকরামুল হক সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে এ বছর তিনটি ধরনই সক্রিয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির এটি অন্যতম কারণ।

অপরদিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বেনারকে জানান, বর্তমানে সক্রিয় তিনটি সেরোটাইপের (ডেন-১, ডেন-২ এবং ডেন-৪) কারণে এ বছর বেশি প্রাণহানি ঘটছে।

দেশে প্রথমবারের মতো ডেন-৪ সেরোটাইপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের প্রায় ১০ শতাংশ এটি বহন করছেন।

ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডাঃ ফজলে শামসুল কবির বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি, এই অভিযোগ সত্য নয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় কম মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু কেন বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা আমরা বলতে পারব না।”

তিনি আরও বলেন, আশা করা যাচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।