গুম ব্যক্তিদের ফেরত চায় পরিবার, অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে

আহম্মদ ফয়েজ
2021.05.28
ঢাকা
গুম ব্যক্তিদের ফেরত চায় পরিবার, অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত চেয়ে নিখোঁজ স্বজনদের ছবি নিয়ে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মানববন্ধন। ২৮ মে ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

গুম হওয়া স্বজনদের সরকারের কাছে ফেরত চেয়েছে তাঁদের পরিবার। তাঁদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অনেক বছর পরেও তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ এর দায় নিচ্ছে না।

যদিও গুমের ঘটনাকে “মিথ্যা অভিযোগ” আখ্যায়িত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন নিখোঁজ ব্যক্তিরা হয়তো নিজেরাই “আত্মগোপনে আছেন,” অথবা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এর পেছনে সরকারের কোনো দায় নেই। 

গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক সপ্তাহ পালনের অংশ হিসেবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শুক্রবার মানববন্ধন আয়োজন করে।

নিখোঁজ স্বজনদের ছবি ও দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে অন্তত ২৫টি পরিবার এতে অংশ নেয়। সমাবেশের মূল ব্যানারে লেখা ছিল ‘গুম বন্ধ করো, গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দাও।’

প্রতি বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্বজুড়ে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে পালন করা হয় গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক সপ্তাহ। 

“২০১৩ সাল থেকে আমরা বিভিন্নভাবে আমাদের চাওয়া সরকারের কাছে বলে আসছি। কিন্তু সরকার সাড়া দিচ্ছে না। আমরা আমাদের স্বজনদের ফেরত চাই। তারা কোথায় আছে, কীভাবে আছে জানতে চাই,” সমাবেশে বলেন মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি। 

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতে গুম হওয়ার দাবি “সব ভুয়া কথা, মিথ্যা অভিযোগ।”

নিখোঁজের ঘটনার ক্ষেত্রে সরকার যথাসম্ভব সবাইকে “উদ্ধার করে এনেছে,” জানিয়ে শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “অনেকে এর মধ্যে ইচ্ছা করে গুম হয়েছে। হয়তো অন্য কোনো দেশে গিয়ে পালিয়ে আছে।”

যাদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁরা কেন গুম হয়েছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এরা বিভিন্ন কারণে গুম হয়ে যায়, নিজেরা নিজেরাই গুম হয়ে যায়। কেউ কোনো ব্যবসায়িক কারণে গুম হয়েছে, কেউবা অন্য কোনো কারণে গুম হয়েছে।”

“এর পেছনে সরকারের কোনো দায় নেই,” দাবি করে তিনি বলেন, “যাকে আমাদের নজরে এসেছে, আমরা উদ্ধারের চেষ্টা করেছি এবং উদ্ধারও করেছি।”

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ৬১১ ব্যক্তি।

অন্য মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ৫৮৭ জনের মধ্যে ১৪৯জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে গুমের শিকার হয়েছেন ১১ জন। 

গুমের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মী অথবা সরকারের সামালোচক। এসব গুমের প্রায় সবগুলো ক্ষেত্রেই স্বজনদের অভিযোগ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর বিরুদ্ধে। 

সন্ধান চান স্বজনেরা

মানববন্ধনে অংশ নেয়া কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেনের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে আনিশা ইসলাম ইশা অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালের ১৯ জুন তার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সরকারের সহযোগিতা পায়নি।

“র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও সরকার কোনো সাহায্য করেনি আমাদের। কিছুদিন আগে মানবাধিকার কমিশন থেকে একটি চিঠি পেয়েছি আমরা, সেখানে লেখা আছে র‌্যাব আমাদের যথাসম্ভব সাহায্য করেছে,” কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন আনিশা।

“কিন্তু আমরা যখন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের অফিসে গিয়েছিলাম, ওখানে ওরা র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেখার পর আমাদের অভিযোগ পড়ে দেখেনি। কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চিঠিতে লেখা আছে, সরকার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে,” বলেন আনিশা।

২০১৩ সালে ডিসেম্বরে বাসার সামনে থেকে গুম হন তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলাম ঝন্টু। মানববন্ধনে অংশ নিয়ে তাঁর মা হাসিনা বেগম বলেন, ঢাকায় অবস্থিত সবগুলো থানা এবং র‌্যাবের অফিসে গিয়েছেন, কিন্তু কেউ বলতে পারেনি তাঁর সন্তান কোথায় আছে। 

গুলশান থানা ছাত্রদলের সভাপতি সাইফুর রহমান সজীব নিখোঁজ হন ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মসে। মানববন্ধনে তাঁর বাবা শরিফুর রহমান বলেন, “আমার চাওয়া, ছেলের কবরটা পেলে জিয়ারত করতে পারতাম।” 

নিখোঁজদের খুঁজে বের করা ‘রাষ্ট্রের দায়’

মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বেনারকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে গুমের বিষয়টাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দেখা হচ্ছে তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

কেউ পালিয়ে থাকলেও তাঁকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের উল্লেখ করে তিনি বলেন, নাগরিকেরা যখন এ ধরনের গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দেহ করেন তখন “এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করা” রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, মানবাধিকার সংগঠন ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দীর্ঘদিন থেকে গুমের শিকার ব্যক্তিরা কে, কোথায় আছেন বা না থাকলে কারা হত্যা করেছে সেসব বিষয় চিহ্নিত করার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানালেও “রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।”

গুম বা নিখোঁজ হওয়ার প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য প্রতিটি ঘটনা অবশ্যই তদন্তের আওতায় আসতে হবে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান।

তিনি বলেন, “যদি কোনো ব্যক্তি গুম হন বা নিখোঁজ হন বা তাকে না পাওয়া যায়, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা।” 

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক মানবাধিকার সংক্রান্ত ২০২০ সালের প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে “গুম ও অপহরণের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে এবং অভিযোগের আঙুল নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে। যদিও এ ধরনের ঘটনা রোধে বা তদন্তের বিষয়ে সরকারে উদ্যোগ অত্যন্ত সীমিত।” 

এতে বলা হয়, “নাগরিক সমাজের অভিযোগ, গুমের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশই বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী এবং ভিন্নমতাবলন্বী। নিখোঁজদের স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কিছু লোকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের না করেই এনে ছেড়ে দিয়েছে, কাউকে গ্রেপ্তার করেছে, কাউকে কাউকে পরে মৃত পাওয়া গেছে এবং অন্যদের পাওয়াই যায়নি।” 

এদিকে শুক্রবার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, “বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গুমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে,” যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত অনুযায়ী “মানবতা বিরোধী অপরাধ।”

“গুমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ক্ষমতাসীন দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে,” বলেও অভিযোগ করা হয় বিবৃতিতে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।