বাংলাদেশে গুম: জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্ত চায় এইচআরডাব্লিউ

আহম্মদ ফয়েজ
2021.08.16
ঢাকা
বাংলাদেশে গুম: জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্ত চায় এইচআরডাব্লিউ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন নিখোঁজ হন ২০১৩ সালে, নিখোঁজদের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে তাঁর ছবি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সুমনের মা আফরোজা ইসলাম আঁখি। ২৮ মে ২০২১।
[সৌজন্যে: মায়ের ডাক]

বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তৎপর হতে দাতা সংস্থা ও বাণিজ্য সহযোগীদের প্রতি আহবান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)।

সোমবার গুমের শিকার ৮৬ ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করে তাঁদের বিষয়ে “যেখানে কোনো আলো পৌঁছায় না: বাংলাদেশে গুমের এক দশক” শিরোনামে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে এইচআরডাব্লিউ।

“জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, দাতা সংস্থা এবং বাণিজ্য সহযোগীদের উচিত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বশীল করে তুলতে, গুম বন্ধ করতে এবং ভবিষ্যৎ হয়রানি বন্ধ করার স্বার্থে এগিয়ে আসা,” বলা হয় ওই বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য এবং নিয়মিত জোরপূর্বক গুমের ঘটনার প্রমাণ মিললেও দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি বন্ধে দাতা দেশগুলো, জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বার বার আহবান জানলেও তাতে পাত্তা দিচ্ছে না সরকার। 

যদিও অতীতের মতোই এসব অভিযোগকে বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও অতিরঞ্জিত বলে দাবি করছে বাংলাদেশ সরকার।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যক্তিকে গুম করেনি বা করে না। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হন এবং কিছু দিন পর ফিরে আসেন বলে আমাদের কাছে খবর আছে।” 

গুম এক নিয়মিত বিষয়

এইচআরডব্লিউ বলছে, যদিও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই আগের সরকারগুলোর সময় থেকেই নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গুম যেন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

আগামী ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে সংস্থাটি জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশের প্রতি আহবান জানাচ্ছে তারা যেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ায়। 

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে দেশে প্রায় ৬০০ মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে কাউকে কাউকে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

“যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের উচিত এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া,” বলা হয় ওই প্রতিবেদনে। 

এতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উচিত অবিলম্বে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সদস্যদের নিষিদ্ধ করা এবং ইতোমধ্যে যারা জাতিসংঘের পতাকা বহনকারী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত কিনা, তা খতিয়ে দেখা। 

উল্লেখ্য, এর আগে একাধিকবার র‌্যাবকে বিলুপ্ত দাবি তোলে বিরোধী দল বিএনপি, যদিও বিএনপির শাসনামলে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ জন্ম লাভ করে সংস্থাটি। র‍্যাব জন্ম হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতি হলেও ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনায় বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়ে। ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবার র‍্যাব বিলুপ্তির দাবি তোলেন। 

এদিকে এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে গুমের শিকার সাতজন ভুক্তভোগীর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।

এই সাতজন হলেন; বিএনপি নেতা আব্দুল কাদের ভূঁইয়া (মাসুম), বিএনপির নেতা নূর হাসান হিরু, ছাত্র শিবির কর্মী মোহাম্মদ রেজাউল হুসাইন, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রাজা, ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাশ, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশেম।

“সরকার এবং বাংলাদেশের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ গুমের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর সঙ্গে উপহাস করে আসছে এবং নিয়মিত তদন্ত কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুমের সঙ্গে জড়িত,” বলেন এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস।

“সরকারের সমালোচকেরা ভয়ের মধ্যে বেঁচে আছে এবং যারা গুম হয়েছে তাঁদের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের উচিত গুম বিষয়ে তদন্ত শুরু করা,” বলেন তিনি। 

অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এইচআরডব্লিউ’র এই প্রতিবেদন সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও মনগড়া দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “কিছু গুম বা খুনের ঘটনা পৃথিবীর সব দেশেই ঘটে। কোনো দেশই এসবের বাইরে না। কিছু ‘আত্মস্বীকৃত বিশিষ্ট ব্যক্তি’ এসব নিয়ে বেশি কথা বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক।”

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরামর্শ আমলে নেয় বলেই তারা বাংলাদেশ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়, যেসব দেশ তাদের পাত্তা দেয় না সেসব দেশের বিষয়ে তারা কিছু বলতে পারে না।

“যখন আমেরিকায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কেউ মারা যায়, তখন তারা এটাকে বলেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আর যখন আমাদের দেশে ঘটে তখন তারা হইচই শুরু করেন এবং বলেন যে, এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এসব দেখে দেখে আমরা বিরক্ত,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

প্রয়োজন স্বাধীন তদন্ত কমিশন

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “আজকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে দাবি তুলেছে, এ রকম দাবি স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সরকার এসব আমলেই নিচ্ছে না।” 

তিনি বলেন, সরকার এমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি, যা মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে আশাবাদী করতে পারে। সরকারের উচিত গুমের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখতে কমপক্ষে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা যাতে করে এই কমিশন গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে পারে,” বলেন নূর খান।

তিনি বলেন, কেউ যদি স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়েও থাকে, তাদের বিষয়েও কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারবে।

“সরকার যদি কমিশন গঠনের এই দাবিকে উপেক্ষা করে তবে তা হবে মানবাধিকারের বিশাল লঙ্ঘন,” যোগ করেন নূর খান। 

এইচআরডব্লিউ যে ৮৬ জনের ছবি প্রকাশ করেছে, তার একজন ঢাকার বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন। তিনি নিখোঁজ হন ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। তাঁর পরিবারের দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে সুমনকে। 

সুমনের বড়ো বোন মারুফা ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে। সরকার এই গুমের দায় এড়াতে পারে না।” 

“জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে আমাদের আহবান বাংলাদেশে গুম বন্ধে এবং গুম হয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন। আমরা ভাইকে ফিরে পেতে চাই,” যোগ করেন মারুফা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।