মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ: নিরপেক্ষ তদন্ত চান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.08.17
ঢাকা
মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ: নিরপেক্ষ তদন্ত চান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট। ১৭ আগস্ট ২০২২।
[বেনারনিউজ]

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট বলেছেন, এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। বুধবার চার দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক ব্যক্তিদের নিয়ে সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল নেত্রনিউজের তথ্যচিত্র ‘আয়নাঘর’ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয় ব্যাশেলেটকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের উচিত ওইসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখা।

তিনি বলেন, “দেখুন অভিযোগগুলো সঠিক নাও হতে পারে। যদি সেগুলো সত্য না হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আপনি তদন্ত করেছেন এবং আপনি জানেন সেটি সঠিক নয়। কিন্তু সেটি যদি সত্য হয়, সেক্ষেত্রে দেখতে হবে কীভাবে সেটির প্রতিকার করা যায়।”

নেত্রনিউজের ১৩ আগস্টের ওই তথ্যচিত্র নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে বিভিন্ন সময়ে বিএনপির অনেক নেতা–কর্মীকে অপহরণ ও গুম করেছে, সেটা ওই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই তথ্যচিত্র বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যাশেলেট বলেন, বাংলাদেশে সংগঠিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছে।

সফরের শেষদিনে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত শেষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব মন্তব্য করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমি সরকারের মন্ত্রীদের সাথে বৈঠকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি এবং এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত করার বিষয়ে আলোকপাত করেছি। এ ছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংস্কারের কথাও বলেছি।”

১৪ আগস্ট চারদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন মিশেল ব্যাশেলেট। এটিই বাংলাদেশে এই পদে অধিষ্ঠিত কোনো হাইকমিশনারের প্রথম বাংলাদেশ সফর।

বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন তিনি।

স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী গুমের অভিযোগ চলছেই’

চিলির সাবেক রাষ্ট্রপতি ব্যাশেলেট বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথেও মঙ্গলবার সাক্ষাত করেন।

এসব বৈঠকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিভিন্ন বাহিনীর হাতে গুম, খুনের শিকার ব্যক্তিদের ভাগ্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।

তবে গুম, খুনের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ জানানো হয়, এখানে কোনো গুম, খুন বা নির্যাতন হয়নি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান হাইকমিশনার ব্যাশেলেটকে জানান, বাংলাদেশে যাদের গুমের কথা বলা হচ্ছে তারা প্রকৃতপক্ষে গুমের শিকার নয়। অনেকেই ঋণ থেকে বাঁচতে, অথবা পারিবারিক কারণে অথবা অন্যকোনও কারণে ইচ্ছা করে লুকিয়ে থাকেন। সে কারণে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে বের হয়ে না আসলে ওইসব ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

তবে সরকারের অবস্থানের বিপরীতে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাশেলেট বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনসহ জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ও নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে। এসব কাজের অধিকাংশই র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন করেছে এবং তাদের কোনো প্রকার জবাবদিহি করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী গুমের অভিযোগ চলছেই এবং এক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় কোনো সুরক্ষা কাজে দেয়নি।

তদন্তে অগ্রগতি না থাকা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়-এমন মন্তব্য করে ব্যাশেলেট বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিবিড়ভাবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত করতে সরকারের উচিত বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমার কার্যালয় প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে প্রস্তুত রয়েছে।”

তিনি বলেন, নির্বাচনকালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মী, বিরোধী দল, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওইসব বিষয় নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যেন অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করে সেব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

ব্যাশেলেট বলেন, সামাজিক অস্থিরতার জন্ম হওয়া এবং সেটি ছড়িয়ে পড়া থেকে দেশকে বাঁচাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সাথে আরও বেশি সংলাপের প্রয়োজন। নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে যুবক-যুবতীদের কথা শুনতে হবে।

সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে তাঁর বৈঠকের কথা উল্লেখ করে ব্যাশেলেট বলেন, “তাঁদের সাথে আমার বৈঠক খুব সমৃদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে সুশীল সমাজের মানুষদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ সক্ষমতা রয়েছে।”

তিনি বলেন, “ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রতিবেদনে নাগরিকদের জন্য স্বল্প অবস্থান, বাড়তি তদারকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রতিক্রিয়া এবং সেলফ সেন্সরশিপের কথা তুলে ধরা হয়েছে।”

ব্যাশেলেট বলেন, বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন আইন ও সরকারি নীতি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কঠিন করেছে এবং কখনও ঝুঁকিপূর্ণ ও সঙ্কুচিত করেছে। ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলো কার্যকর-ভাবে কাজ করতে পারছে না।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ

বাসস জানায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

বৈঠকে তাঁরা বর্তমান বিশ্ব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং একমত হন যে চলমান কোভিড-১৯ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বিশ্বজুড়ে সংকট তৈরি করেছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার এখনও তাদের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের প্রত্যাবাসনে সাড়া দেয়নি।

তিনি বলেন, মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ব্যাশেলেট কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।

প্রধানমন্ত্রী জবাবে বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য তাঁরা সেই সুযোগের ব্যবস্থা করতে পারেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।