বাংলাদেশে গুমের বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করল একটি মানবাধিকার সংগঠন

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.09.13
ঢাকা
বাংলাদেশে গুমের বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করল একটি মানবাধিকার সংগঠন ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি হাতে তাঁদের স্বজনদের মানববন্ধন। ৩০ আগস্ট ২০২১।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশে গুম-খুন ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়টি আমলে নিয়ে তা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হংকং ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্সেস সেন্টার (এএলআরসি)।

সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সভা শুরুর দিনেই বাংলাদেশে গুম-খুনের বিষয়ে লিখিত বিবৃতি জমা দেয় সংগঠনটি। এর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচও বাংলাদেশে গুম-খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে আহ্বান জানায়।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী সপ্তাহে নিউইয়র্ক যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলো এএলআরসি। 

সংগঠনটির মতে, গুম-খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা করছে না। সে কারণে বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে গুম-খুনের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়েছে।

তবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ওই বিবৃতি প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার মাত্র। এগুলোকে আমরা আমলে নিতে চাই না।” 

বিরোধীদের দমন করতে ‘গুম’

এএলআরসি জানিয়েছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদের দমন করতে বর্তমান সরকার যে কয়টি কৌশল অবলম্বন করেছে, গুম এগুলোর অন্যতম।

বাংলাদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের বরাত দিয়ে তারা জানিয়েছে, ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত মোট ৬০৩ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুম করেছে।

সংগঠনটি জানিয়েছে, গুমের শিকার প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। কারণ, সবাই পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গুমের কথা বলেন না।

সংগঠনটির হিসাবে গুম হওয়া ৬০৩ জনের মধ্যে ১৮৯ জন র‌্যাবের হাতে, ১৮১ জন পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার হাতে, ৮৫ জন পুলিশের হাতে, ১২ জন র‌্যাব-পুলিশ যৌথ বাহিনীর হাতে, দুইজন আনসার-পুলিশ যৌথ বাহিনীর হাতে, একজন শিল্প পুলিশের হাতে এবং ১৩৩ জন অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে গুমের শিকার হয়েছেন।

এই ৬০৩ জনের মধ্যে পরবর্তীতে ৮৩ জনের লাশ বিভিন্নস্থানে পাওয়া গেছে, ৩৬৯ জনকে কারাগারে অথবা অন্যস্থানে পাওয়া গেছে। বাকিদের এখন পর্যন্ত কোনো সন্ধান নেই। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খানের মতে “গুম-খুন নিয়ে এএলআরসির এই লিখিত বিবৃতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের ওপর কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে যেসব আন্তর্জাতিক সংগঠন কাজ করে সেগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সেকারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর বিবৃতি কিছুটা হলেও পরিস্থিতিকে জানান দিতে পারবে।” 

‘যাঁরা হারিয়ে গেছে, তাঁরা কোথায়!’

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের নেতাকর্মীদের গুম-খুন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আসে।

সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ আসে বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসারের আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায়।

দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে ঢাকা মহানগরের বনানী এলাকা থেকে অপহৃত হন ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়ি চালক। এরপর থেকে তাঁদের আর খোঁজ মেলেনি।

গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ গত সাত বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে পরিবারের সদস্যদের সন্ধান চেয়ে মানববন্ধন করে আসছেন।

‘মায়ের ডাক’ এর সংগঠক সানজিদা ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের সাথে যাঁরা যোগাযোগ করেছে, সেই অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৫৩২টি পরিবার জানিয়েছে তাদের পরিবারের সদস্য নিখোঁজ আছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ অনেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি।

তিনি বলেন, “যাঁরা হারিয়ে গেছে, তাঁরা আর ফিরে আসেনি। আমরা কেউ জানি না কারা তাদের নিয়ে গেছে। তাঁরা কোথায়!”

সানজিদা বলেন, “প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপের কাছে বাংলাদেশে গুমের শিকার মানুষের তালিকা আছে। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।”

“আমাদের চাওয়া, আমাদের স্বজনদের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হোক। কিন্তু আমাদের কখনও কিছু বলা হয় না,” বলেন সানজিদা।

সানজিদার ভাই সাজিদুল ইসলাম সুমন শাহীনবাগ এলাকায় বিরোধীদল বিএনপির ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। 

সানজিদা জানান, ২০১৪ সালের জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের আগে ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র‌্যাব-১ লেখা একটি গাড়িতে করে সুমনকে উঠিয়ে নেয়া হয়। এরপর থেকে তাঁর আর সন্ধান মেলেনি। তবে র‌্যাব বরাবরের মতো সুমনসহ কারও নিখোঁজ হওয়ার সাথে তারা জড়িত নয় বলে দাবি করে আসছে। 

এদিকে “সরকার কোনো মানুষকে গুম করে না। গুমের যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে এগুলো সঠিক নয়,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন ফারুক খান।

তিনি বলেন, “জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে এসব চিঠি পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই। এগুলোর কোনো কার্যকারিতা নেই।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশে যেগুলোকে গুম করার কথা বলা হয় সেগুলো আসলে গুমের ঘটনা নয়। অনেকে ঋণ থেকে মুক্তি পেতে আত্মগোপন করে। অনেকে এনজিওর কিস্তি শোধ করতে না পেরে আত্মগোপনে যায়। অনেকে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মগোপনে যায়, সাংসারিক অশান্তি থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে যায়। আবার অনেকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়েও আত্মগোপনে যায়।”

“সুতরাং, কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া না গেলেই তাঁকে গুম করা হয়েছে বলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা সঠিক নয়,” যোগ করেন সরকারের সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।