নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, সরকার ক্ষুব্ধ
2022.12.14
ওয়াশিংটন ডিসি
এক দশক আগে গুমের শিকার বিরোধী দলের এক নেতার বোনের বাসায় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আকস্মিক পরিদর্শনের ঘটনায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপোড়েনের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে, বুধবারই সরকারের দুজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিজাত নিরাপত্তা বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তার মূল কারণও ছিল বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বুধবার ভুক্তভোগী পরিবারের বাসায় উপস্থিত হওয়ার পর কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী একটি নতুন সংগঠনের ব্যানারে সেখানে জড়ো হন। নিরাপত্তাকর্মীদের অনুরোধে রাষ্ট্রদূত তাঁর গাড়িতে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
বুধবার সকালে ওই ঘটনার পর বিকেলে ঢাকার আমেরিকান সেন্টারে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রাইডেনাওয়ার সাংবাদিকদের জানান, “নিরাপত্তাজনিত কারণে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সেখান থেকে দ্রুত চলে এসেছিলেন। এ বিষয়টি দূতাবাসের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বুধবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করে নিজের নিরাপত্তা শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ নিয়ে সরকারপ্রধান, কয়েকজন মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন।
নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসা ঢাকার শাহীনবাগ এলাকায়, সেখানেই তাঁর বোন বসবাস করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ওই বাসায় অন্যান্যের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বাংলাদেশ ডেস্কের অফিসার লিকা জনসন।
ঘটনা যেভাবে শুরু
বুধবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে শাহীনবাগে সুমনের বাসায় যান রাষ্ট্রদূত। সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম ‘গুমের’ শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়কারী। সংগঠনটি মাঝেমধ্যে গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার বা সন্ধান দাবিতে কর্মসূচি পালন করে থাকে।
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি নেতা সুমনকে। তিনি বিএনপির ঢাকা মহানগরের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির (বর্তমানে ঢাকা উত্তরের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সুমনের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যাওয়ার খবরে সেখানে ‘মায়ের কান্না’ নামের একটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়ো হন। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যের ফাঁসি ও কারাদণ্ড হয়। চাকরিচ্যুত হন অনেকেই। সেসব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠন। এটাকে ‘মায়ের ডাক’ এর কাউন্টার সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বুধবার ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের সদস্যরা সুমনের বাসার সামনের রাস্তায় অবস্থান নেন। রাষ্ট্রদূত বাসায় ঢোকার সময় তাঁরা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রদূত সেখান থেকে বের হওয়ার পর তাঁর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। এতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কথা বলার আহ্বান জানানো হয়।
সানজিদা ইসলাম বেনারকে বলেন, “মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাদের বাসায় আসার ৪০ মিনিট আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও মায়ের কান্না সংগঠনের লোকজন রাস্তার ওপর অবস্থান নেন। বাসা থেকে বেরিয়ে যখন তিনি গাড়িতে উঠছিলেন, তখন তাঁরা কথা বলার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে হট্টগোলও হয়। পরে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় তিনি গাড়িতে উঠে চলে যান।”
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনার বিষয় জানতে চাইলে সানজিদা বলেন, “পিটার হাস নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন। আমরা তাঁর কাছে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছি।”
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বুধবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে তার সঙ্গে দেখা করেছেন।
“সাক্ষাৎ করে উনি বললেন যে, উনি গিয়েছিলেন একটি বাসায়, কিন্তু বাইরে বহু লোক ছিল এবং তারা উনাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন এবং উনার সিকিউরিটির লোকেরা তাঁকে বলেছে যে, আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান, কারণ ওরা আপনার গাড়ি ব্লক করে দেবে,” বলেন মন্ত্রী।
রাষ্ট্রদূতকে অধিকতর নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “তবে আপনি ওখানে গেছেন এই খবরটা কে প্রকাশ-প্রচার করল? আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছুই জানে না, আপনি আমাদের জানান নাই।”
“আমি রাষ্ট্রদূতকে বললাম, আপনার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমাদের। আপনার ওপর কিংবা আপনার লোকের ওপর কেউ আক্রমণ করেছে? তিনি বললেন, না। বললেন, উনার গাড়িতে হয়তো দাগ লেগেছে, তবে ওটা শিওর না।,” জানান মন্ত্রী।
বিএনপির নিখোঁজ নেতার বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যাবেন- এই তথ্য কে ফাঁস করেছে, সেটি বের করতে রাষ্ট্রদূতকে পরামর্শ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, তার যাওয়ার তথ্য কে ফাঁস করল জানতে চাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জবাব দিতে পারেননি।
রাষ্ট্রদূত কোনো অনুষ্ঠানে গেলে, সেখানে গণমাধ্যমকে আটকে রাখা যাবে না বলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমি বললাম, আমি মিডিয়াকে আটকাতে পারব না। আমাদের দেশের মিডিয়া খুব সোচ্চার, আপনারা যদিও বলেন ওদের ফ্রিডম অব স্পিচ নেই।”
মন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রদূত কোথাও গেলে সেখানে জড়ো হওয়া মানুষদের তিনি আটকাতে পারেন না। তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের দূরে রাখতে পারেন। বাংলাদেশে সবার বাকস্বাধীনতা রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেলে খুশি হতাম: কাদের
রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, “সুমনের বাসায় যাওয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেলে দেখতে ভালো লাগত। উনি চলে গেছেন সুমনের বাড়িতে।”
আলোচনা সভায় সভাপতি হিসেবে মঞ্চে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাহেব আজকে ভোরবেলায় বুদ্ধিজীবী দিবসে সুমনের বাড়িতে গেলেন। আমি সবিনয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে কতজন গুম হয়, সেই চিত্রটা কিন্তু সিএনএনে আমরা দেখেছি। কতজন নারী ধর্ষিত হয়, সেটাও আমরা দেখেছি। কতজন খুন হয়, সেই চিত্রও আমরা দেখেছি।”