খসড়া প্রকাশ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আদলেই হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন
2023.08.10
ঢাকা
![খসড়া প্রকাশ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আদলেই হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন খসড়া প্রকাশ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আদলেই হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন](https://www.benarnews.org/bengali/news/bd-dsa-08102023161232.html/@@images/288113de-a77e-4e5d-918b-c33a5d5e6d8f.jpeg)
ব্যাপক অপব্যবহারের কারণে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে নতুন যে আইন সরকার করতে যাচ্ছে সেটিও প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক সংস্করণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খসড়া আইন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব বিধানই বলবৎ থাকছে সাইবার নিরাপত্তা নামের নতুন আইনটিতে। এ নিয়ে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী এবং আইনজ্ঞসহ অংশীজনেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বুধবার সন্ধ্যায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করেছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। আইনটির খসড়া প্রস্তুত করার আগে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নেয়া হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় অংশীজনদের মতামত নিয়ে নতুন আইনটি চূড়ান্ত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সরকার জানিয়েছে, প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে ১৪ দিন মতামত নেওয়া হবে। প্রয়োজনে খসড়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামতও গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান আইনমন্ত্রী। এ সময় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ উপস্থিত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের আগে আইনটি নিয়ে জনগণের মতামত নেওয়া উচিত ছিল। সরকার ভেবেছিল আইন মন্ত্রণালয় ভেটিংয়ের পর খসড়াটি সংসদীয় কমিটি হয়ে সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবে। কিন্তু সমালোচনার মুখে এখন মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে যাচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নূর খান বেনারকে বলেন, “আসলে সাইবার নিরাপত্তা আইনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেকটি নতুন সংস্করণ। এটি নতুন বোতলে পুরোনো মদ। কোনো অংশীজনের মতামত ছাড়াই এটি মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট ১৪টি ধারায় সংঘটিত অপরাধ অজামিনযোগ্য ছিল, সেখানে প্রস্তাবিত আইনে ছয়টি ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য। এছাড়া পুরোনো আইনের একটি বিধানে যেখানে জেল-জরিমানার পরিমাণ বেশি ছিল, নতুন আইনে সেটিকে কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
“এর অর্থ হলো, অপরাধের ধরন একই থাকছে। শুধু সাজা কমছে,” বলেন নূর খান।
এ সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদ বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছে, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলে শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা অর্থহীন।”
“প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদপত্রের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন।”
দুটি আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। দুটি আইনের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকমের।
এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন, সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের যেসব আপত্তি-উদ্বেগ ছিল, প্রস্তাবিত নতুন আইনেও সেসব দূর করা হয়নি। শুধু কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমেছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বেড়েছে।
নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে ৬২টি। প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান রয়েছে।
কোন কোন পরিবর্তনের দাবি ছিল?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২১, ২৮ ও ২৯ ধারা। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের পক্ষ থেকে ২১ এবং ২৮ ধারা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনে সেগুলো বাদ দেয়া হয়নি।
আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালালে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ড।”
প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের সাজা অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের ধারা ২৮ অনুসারে, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে বা উস্কানি দিয়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রকাশ বা প্রচার করলে সাজা অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড, অথবা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ড। নতুন আইনে এই অপরাধের সাজা দুই বছর জেল অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।
এই ধারার মাধ্যমে অধিকার কর্মী, সাংবাদিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য এবং বিরোধীপক্ষকে দমন করতে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সাজা অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। নতুন আইনে এই অপরাধে কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মোট নয়টি ধারা বাতিলের দাবি করেছিল সম্পাদক পরিষদ। সেগুলো হলো: ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ এবং ৫৩ ধারা।
তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮ ধারা একই রকম রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা অনুসারে কাউকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ অথবা হেয় প্রতিপন্ন করতে কোন তথ্য, উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ও প্রচার করলে এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অথবা সুনাম ক্ষুণ্ণ করলে তিন বছর কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। নতুন আইনে এই বিধান হুবহু রেখে সাজার পরিমাণ কমিয়ে দুই বছর জেল এবং তিন লাখ টাকা করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো সংক্রান্ত ধারা ৩১, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ভঙ্গ সংক্রান্ত ধারা ৩২, পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি সংক্রান্ত ধারা ৪৩ প্রায় অবিকল রেখে সাজার মেয়াদ কিছুটা কমানো হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলা নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলো আরেকটি নতুন আইনে সংযোজন করে কোনো লাভ হবে না। এই আইনের নিবর্তনমূলক চরিত্র ভিন্নমত দমন করবে।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সুশীল সমাজের অবস্থানকে সঙ্কুচিত করেছে এবং জনগণের বেঁচে থাকা ও মত প্রকাশের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। সেকারণে অধিকার কর্মীরা আইনটি বাতিল চাইছেন; নতুন কোনও আইনে এর বিধানগুলো প্রতিস্থাপন চাওয়া হয়নি।”
“কিন্তু আমরা যা দেখলাম সেটি হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির প্রায় সব ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে সংযোজন করা হয়েছে,” বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।