এক বছরের ব্যবধানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ হয়েছে ৯ গুণ বেশি
2022.01.03
ঢাকা
স্বাধীন মত প্রকাশে অন্যতম বাধা ও নিপীড়নমূলক বলে পরিচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে প্রায় ৯ গুণ বেশি হয়েছে বলে জানা গেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক প্রতিবেদনে।
দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত শুক্রবার প্রকাশিত আসকের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৪টি।
আসকসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালে এই আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ছিল ১৩০টি, যা ২০২১ সালে বেড়েছে প্রায় নয় গুণ।
“বছরজুড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার হয়েছে ভিন্নমত দমন করার লক্ষ্যে এবং হয়রানিমূলক উপায়ে মানুষের অধিকার হরণের জন্য,” বলছে আসকের প্রতিবেদন।
এই প্রতিবেদনে ২০২১ সালকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “এ বছর বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনা, যেখানে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, গুম, ধর্ষণ, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গা নেতা খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা।”
তবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দায়ের মামলাগুলোতে গ্রেপ্তারের ঘটনা থাকলেও কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কত সংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনটি প্রয়োগ করা হয়েছে তা বলা হয়নি আসকের এই প্রতিবেদনে।
‘দুর্বলতা’ খুঁজে পেলে আইনটি সংশোধন হবে: আইনমন্ত্রী
আসকের প্রতিবেদন প্রকাশের দুই দিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো অসঙ্গতি থাকলে সরকার আইনটি সংশোধন করবে। সেই লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে আইন মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরো কিছু বিভাগ একযোগে কাজ করছে।”
তিনি জানান, আইন প্রয়োগের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা সেটি খুঁজে বের করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৬ সদস্যের একটি টিম।
“তারা যদি আইনে এমন কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায় যা মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাহলে আমরা আইনটি সংশোধনের ব্যবস্থা করব,” বলেন মন্ত্রী।
আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দেয়া এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, “বিলম্বে হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের ঘটনা স্বীকার করে আইনটির নিবর্তনমূলক ধারাসমূহ সংশোধনীর বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যকে সতর্ক সাধুবাদ জানাচ্ছে টিআইবি।”
একইসাথে এই বক্তব্যের কার্যকর বাস্তবায়ন দেখতে নিবর্তনমূলক এই আইনটি মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না তা পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটিতে গণমাধ্যমকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায় টিআইবি।
‘প্রধানতম টার্গেট সাংবাদিকরা’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল ১৯ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বেনারকে বলেন, “সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই আইনটি সংশোধন করা এবং এর নিপীড়নমূলক ধারাগুলো বাদ দেয়া।”
“এই আইনটিকে সরকার প্রয়োগ করছে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্য, যার প্রধানতম টার্গেট সাংবাদিকরা,” যোগ করেন ফয়সল।
তিনি বলেন, “মানবাধিকারের খারাপ পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন খুবই খারাপ, তাই কোনো প্রকার সময়ক্ষেপণ না করে সরকারের উচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্রুত সংশোধন করা।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া তিনটি মামলা মোকাবেলা করছেন নির্যাতিত ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
তিনি বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অধিকার প্রশ্নে মানুষের কথা বলা বন্ধ করার মূল হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আইনটি অবিলম্বে বাতিল হওয়া উচিত এবং এই আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোও বাতিল করতে হবে।”
“সমাজের সব মানুষের জন্য এই আইনটি আতংকের কারণ। তবে এটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাংবাদিকদের জন্য,” যোগ করেন কাজল।
বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৮০ জন
আসকের হিসাব মতে, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার হয়েছেন সাতজন, যাদের ছয়জনকে পরবর্তীতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। অপরজনের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। একই ভাবে ২০২০ সালে ছয়জন গুম হলেও চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং দুইজনের কোনো খোঁজ মেলেনি।
২০২১ সালে নিখোঁজ ব্যক্তি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার একজন ব্যবসায়ী। তাঁর নাম ইমাম মেহেদী হাসান। গত বছরের নভেম্বরের শুরুতে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইমাম মেহেদী হাসানের স্ত্রী আসককে জানিয়েছেন তাঁর স্বামীকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন।
“এই হত্যাকাণ্ডে শিকারদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর হাতে ‘ক্রসফায়ার’বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ৫১ জন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন এবং একজন গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন,” বলেন আসকের মহাসচিব নূর খান লিটন।
তিনি বেনারকে বলেন, “সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন দাবি করছে আসক।”
তিনি বলেন, ২০২১ সালে কমপক্ষে ২১০ জন সাংবাদিক নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী এবং ক্ষমতাসীন দলেন নেতা–কর্মীদের মাধ্যমে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমার জানামতে, দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমের কোনও ঘটনা ঘটে না। যদি কোনও ঘটনা ঘটে, সেগুলো তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
“সবার জন্য আইন সমান। আমি সবাইকে বলবো কারও সাথে কোনও ঘটনা ঘটলে তারা যেন অবশ্যই আদালত বা থানায় অভিযোগ করে,” যোগ করেন তিনি।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩২১ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২৮ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৭৭ জন পুরুষ। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনজন নারীসহ আটজন খুন হয়েছেন।
এ ছাড়াও নির্বাচনী সহিংসতার ৬২৭টি ঘটনায় কমপক্ষে ১১৩জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন সাত হাজারেরও বেশি মানুষ।