নেত্র নিউজ সম্পাদক তাসনিম খলিলসহ চার জনের সম্পত্তি ক্রোক করতে আদালতের নির্দেশ
2021.10.19
ঢাকা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারে জড়িত থাকার অভিযোগে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় নেত্র নিউজের সম্পাদক ও সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিলসহ চারজন আসামি আদালতে উপস্থিত না থাকায় তাঁদের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
“নির্ধারিত দিনে আদালতে হাজির না থাকায়” আসামিদের পলাতক হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের মালামাল ক্রোক করতে আদালত সংশ্লিষ্টদের প্রতি এই নির্দেশ জারি করে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম।
ট্রাইবুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন সোমবার এই আদেশ দেন বলে জানান তিনি।
তবে এই মামলাটিকে ‘হাস্যকর’ আখ্যা দিয়ে তাসনিম খলিল মঙ্গলবার বেনারকে জানান, “মামলাটির বিষয়ে আদালত বা সরকার আমাকে কোনো সমন বা নোটিশ দেয়নি। এরই মধ্যে আমার সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ কৌতুকপ্রদ।”
সম্পদ ক্রোকের আওতায় থাকা অপর তিন আসামি হলেন; হাঙ্গেরি প্রবাসী সামিউল ইসলাম খান সামি ওরফে জুলকারনাইন, ব্লগার আশিক মোহাম্মাদ ইমরান এবং মো. ওয়াহিদুন্নবী ওরফে স্বপন ওয়াহিদ।
২০২০ সালের ৫ মে র্যাবের পক্ষ থেকে রমনা থানায় কার্টুনিস্ট কিশোর, লেখক মুশতাক, রাষ্ট্রচিন্তা নামে সংগঠনের ঢাকার সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া, মিনহাজ মান্নান, জুলকারনাইন, ও তাসনিম খলিলসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই মামলাটি দায়ের করা হয়।
মামলার অভিযোগ সম্পর্কে পিপি নজরুল বেনারকে জানান, “কার্টুনিস্ট কিশোর তাঁর ‘আমি কিশোর’নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন পোস্ট করতেন। মুশতাক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেছেন।”
“আসামিরা ‘আই এম বাংলাদেশি’ নামে ফেসবুক পেজে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিয়েছেন, যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়,” বলেন পিপি নজরুল।
তবে অভিযুক্তরা কে কীভাবে ‘আই এ্যাম বাংলাদেশী’ পেজের সাথে সংশ্লিষ্ট, বা তাঁদের নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে কখন, কীভাবে বা কোন পোস্টে তারা অপপ্রচার ছড়িয়েছেন, “এসব কোনো কিছুই এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি,” বলে জানানো হয় ২০২০ সালের মে মাসে নেত্র নিউজে প্রকাশিত এক মন্তব্য প্রতিবেদনে।
এছাড়া এজাহারে ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে তাসনিম খলিল অন্যদের সাথে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিং’-এ যুক্ত থাকার “অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া” অভিযোগের পক্ষে “কোনো সারবত্তা নেই,” বলেও দাবি করা হয় সেই প্রতিবেদনে।
র্যাবের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের পরদিন মিনহাজ মান্নান ও দিদারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়, পরে তাঁরা জামিনে ছাড়া পান। গ্রেপ্তার অবস্থায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কারাগারে মারা যান লেখক মুশতাক। পরবর্তী সময় কার্টুনিস্ট কিশোরও জামিনে মুক্ত হন।
গত ১৩ জুন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আফছার এই মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন এবং পরবর্তীতে আদালত ১২ সেপ্টেম্বর চার্জশিট গ্রহণ করে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত এগারো জনের মধ্যে রোববার জুলকারনাইনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। নিহত লেখক মুশতাক ছাড়া অব্যাহতিপ্রাপ্ত অপর তিনজন হলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক সাহেদ আলম, জার্মান প্রবাসী ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন ও ফিলিপ শুমাখার।
এই মামলাটির তদন্ত করেছেন, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) আফছর আহমেদ এবং মামলার তদারককারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ।
আদালতের নির্দেশনা হাতে পাওয়ার পর আসামিদের সম্পদ রয়েছে এমন জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্রোক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে বেনারকে জানান জ্যোতির্ময়।
পরবর্তী শুনানির দিন তদন্তকারী সংস্থাকে ক্রোক সংক্রান্ত অগ্রগতি আদালতকে জানাতে হবে বলে জানান পিপি নজরুল।
তবে বাংলাদেশে ক্রোক করার মতো তাঁর কোনো “স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি নেই,” বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান তাসনিম খলিল।
গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম ‘আল জাজিরায়’ বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধানকে নিয়ে “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টারস মেন” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে মূল তথ্যদাতার ভূমিকায় ছিলেন হাঙ্গেরিতে বসবাসরত জুলকারনাইন। তাসনিম খলিল এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে ভূমিকা রাখেন।
কুষ্টিয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক গ্রেপ্তার
মঙ্গলবার কুষ্টিয়ায় কুমারখালী উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ ইমরানের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার কুমারখালী উপজেলা প্রতিনিধি ফরহাদ আসিফ টিপুকে (৫০) জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
যুবলীগ নেতা মামলাটি করার পরপরই টিপুর বাটিকামারি এলাকার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে জানান কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার।
“সাংবাদিক টিপু তার ফেসবুকে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে একটি আপত্তিকর পোস্ট শেয়ার করেন,” বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে সাংবাদিক টিপুকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আল-মামুন সাগর বেনারকে বলেন, টিপুর পরিবারের সদস্যরা তাঁদের জানিয়েছেন “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়” নামক একটি ফেসবুক আইডি থেকে দেয়া ওই পোস্টটি “টিপুর সাত বছরের শিশু সন্তান বাবার মোবাইল নিয়ে খেলতে গিয়ে শেয়ার করে থাকতে পারে পরিবারের ধারণা।”
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা খুবই শঙ্কার মধ্যে থাকি। এই আইনটি সংশোধন অথবা বাতিল হওয়া জরুরি,” বলেন তিনি।
গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের হবার সাথে সাথেই যেন সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা না হয় সেজন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
“এই আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় বের করার ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত আন্তরিক,” বলেন আইনমন্ত্রী।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গত ২১ মাসে হওয়া ৬৬৮টি মামলা পর্যবেক্ষণ করে সিজিএস দেখতে পেয়েছে, এই মামলাগুলোর বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা না হয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাঁদের নেতাদের পক্ষ হয়ে করেন।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততায় যেসব মামলা সিজিএস খুঁজে পেয়েছে, তার ৮৫ ভাগই করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিজিএস ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৬৮টি মামলার বিবরণ বিশ্লেষণ করেছে, যাতে দেখা গেছে মামলাগুলোয় অভিযুক্তের সংখ্যা ১ হাজার ৫১৬, যার মধ্যে ১৪২ জন সাংবাদিক, ৩৫ জন শিক্ষক, ১৯৪ জন রাজনীতিবিদ এবং ৬৭ জন শিক্ষার্থী।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক ২৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ।