বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিধান রেখেই সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস
2023.09.13
ঢাকা
বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য ও অন্যান্য অংশীজনের বিরোধিতার মধ্যেই বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিধান রেখে বুধবার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা বিল পাস করেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ।
রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবার পর বিলটি দেশের আইনে পরিণত হবে।
প্রস্তাবিত আইনে সাইবার স্পেসে মানহানিকর কাজের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ডের সাজার পরিবর্তে ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে।
বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারার অধীনে যেসব অপরাধ অজামিনযোগ্য ছিল, বিলে তা জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
বিলে অজামিনযোগ্য অপরাধগুলো হলো; মূল তথ্য পরিকাঠামোতে অনুপ্রবেশ, কম্পিউটার এবং কম্পিউটার সিস্টেমের ক্ষতি, সাইবার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ।
নতুন বিল পাসের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হলেও ওই আইনে দায়ের মামলাগুলোর বিচারকাজ পুরোনো আইনের অধীনেই চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে সাংবাদিক নেতারা বিলের ৪২ ধারা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। এই ধারা অনুযায়ী, পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই যে কোনো স্থানে বা ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
সাংবাদিক নেতারা এই ধারাটি বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। তবে কমিটি তাঁদের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
এই বিধানের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক পরবর্তীতে সাংবাদিকদের বলেন, সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এটি আইনে রাখা হয়েছে।
তবে কমিটি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩২ ধারা বাদ দেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। খসড়া আইনের ওই ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি এই ধারায় কোনো অপরাধ করেন বা ঔপনিবেশিক যুগের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ এর অধীনে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অপরাধ করতে কাউকে সহায়তা করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের সম্মুখীন হবেন।
প্রস্তাবিত আইনে মিথ্যা মামলা দায়েরকে অপরাধ বিবেচনা করে কমিটি নতুন একটি ধারা সংযুক্ত করেছে। ফলে কোনো ব্যক্তি মিথ্যা অভিযোগ করলে আবেদনের ভিত্তিতে উল্টো সাজার মুখে পড়বেন, সেই সাজা হবে মূল অপরাধের দণ্ডের সমান।
সাইবার নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের মিথ্যা ও অপপ্রচার চালানো বা সমর্থন করার জন্য ব্যক্তি পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
‘মিডিয়া সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য হবে’
সংসদে নতুন বিল পাসের সময় এর বিভিন্ন ধারার সমালোচনা করে বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতারা বলেন, সংবিধানে দেওয়া চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে এই আইনের ফলে।
একাধিক সদস্য পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও তল্লাশির বিধান সংশোধনের দাবি জানান।
“প্রস্তাবিত আইনে অনেক বিধান রয়েছে, যা সরাসরি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনের কারণে মিডিয়া সেলফ সেন্সরশিপে যেতে বাধ্য হবে,” সংসদে বলেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, “আইনের বিভিন্ন ধারায় স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।”
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, “এই আইন ভিন্নমত ও মুক্তচিন্তাকে দমনের অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার।”
“গত সাড়ে চার বছরে, এটি (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) শুধু সমালোচনা এবং মুক্তচিন্তা দমন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যা সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে যায়। এটি সাংবাদিকদের নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল,” বলেন তিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে এই বিরোধী আইনপ্রণেতা বলেন, “এই আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “নতুন আইনে পুলিশকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই বাড়িতে প্রবেশ এবং দেহ তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো আইন পুলিশকে এত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।”
‘আগের আইনের অনুলিপি’
সংসদে পাশ হওয়া বিলটি সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছু শাস্তি পরিবর্তন করে সিএসএ তৈরি করা হয়েছে। এটা আগের আইনের অনুলিপি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
“ডিএসএ রহিত করে এর স্থলে প্রস্তাবিত সিএসএ ২০২৩ প্রণয়ন করার সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে যে, ডিএসএর ব্যবহার ও অপব্যবহারের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বিভিন্ন মৌলিক মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘনের ফলে জনমনে যে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ তৈরি হয়েছে, সরকার তা অবসানের বাধ্যবাধকতার যথার্থতা উপলব্ধি করেনি,” বলেন তিনি।
ইফতেখার বলেন, “সরকার স্টেকহোল্ডারদের মতামত না নিয়েই আইন প্রণয়ন করেছে।”
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেন, “সিএসএ নিয়ে আমাদের অনেক উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশকে গ্রেপ্তার করতে দেওয়া খুবই নিপীড়নমূলক। আমরা দমনমূলক বিধান বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।”
ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্কের সদস্য সফটওয়্যার প্রকৌশলী ও অ্যাকটিভিস্ট দিদারুল আলম ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “সিএসএ আসলে ডিএসএর মতোই একটি নিপীড়নমূলক আইন। আমরা এখনো ডিএসএ বা সিএসএ এবং অন্য কোনো দমনমূলক আইন; যা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করছে, তা বাতিল করার দাবি করছি।”
তিনি বলেন, “স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার আইনটি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে।”
“নির্বাচনের আগে বিরোধী মত দমনে এই নতুন আইন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হবে,” আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বুধবার সংসদে সাইবার নিরাপত্তা বিলটি উত্থাপন করেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, পরে তা কন্ঠভোটে পাস হয়।
এর আগে গত ৭ আগস্ট আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি রূপান্তর ও আধুনিকায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার নাম হবে সাইবার নিরাপত্তা আইন।