প্রত্যাহার হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলা, মুক্তি পাবেন গ্রেপ্তারকৃতরা
2024.09.30
ঢাকা
মুক্তমত প্রকাশ করায় সাইবার আইনে দায়ের মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক মুক্তি পাবেন।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ড. মো. রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার এসব সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৫ হাজার ৮১৮ টি মামলা চলমান রয়েছে।
মামলাগুলোর মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তমত প্রকাশের কারণে দায়ের মামলাগুলোকে 'স্পিচ অফেন্স' এবং কম্পিউটার হ্যাকিং বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতিকে 'কম্পিউটার অফেন্স' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ড. রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “স্পিচ অফেন্স সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।” তবে কম্পিউটার অফেন্স সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ওই মামলাগুলো চলমান থাকবে।
বর্তমানে স্পিচ অফেন্স সম্পর্কিত মোট এক হাজার ৩৪০টি মামলার মধ্যে ৪৬১টি তদন্তাধীন এবং ৮৭৯টি বিচারাধীন বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এতে বলা হয়, বিচারাধীন মামলাগুলো আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে এবং তদন্তাধীন মামলাগুলো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
‘হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত’
ফেসবুকে করা এক মন্তব্যের কারণে ২০১৭ সালের ৭ জুন সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অভিযোগ দায়ের করেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ওই অভিযোগের তদন্ত চলে চার বছর ধরে।
জানতে চাইলে আফসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রধান উদ্দেশ্যে ভয়-ভীতি ও হয়রানি করা।”
তাঁর বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি মামলা করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “চার বছর ধরে যে কষ্ট গেছে এবং মানসিক যেসব দুশ্চিন্তা ছিল সেটা ভাবা যায় না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমার জীবনটা একেবারে ধাক্কা দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছে। …তখন আমাকে পালাতে হয়েছিল।”
বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করার জন্য যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা হয়েছিল কিন্তু তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি তাঁদেরকে “হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত,” বলে মনে করেন তিনি।
মুক্তমত প্রকাশের দায়ে সাইবার আইনের মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বেনারকে বলেন, “বাক স্বাধীনতা অবাধ হওয়া উচিত। সরকারের সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। কিন্তু কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং সংস্কার কীভাবে হবে, সেটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।”
“কেউ যদি কোনো খারাপ কথা বলে থাকে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তার অর্থ এই নয় যে বাক স্বাধীনতা থাকবে না, কেউ কোনো কিছু বলতে পারবে না।”
“বাক স্বাধীনতা থাকতেই হবে,” যোগ করেন তিনি।
সাইবার নিরাপত্তা আইন ‘সংস্কার প্রয়োজন’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ কিছুটা সংশোধন ও পরিমার্জন করে ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন নাম দিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত সরকার।
বিতর্কিত এই আইনের বিপক্ষে অবস্থান নেন মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক সমাজসহ সংশ্লিষ্টরা।
সাইবার নিরাপত্তা আইন “সংস্কার প্রয়োজন” এবং দ্রুত সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে গত রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫ বছরের চিত্র নিয়ে কঠিন পরীক্ষা’ নামে একটি গবেষণা প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
ওই গবেষণায় ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরে চার হাজার ৫২০ জনকে অভিযুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়, যাদের মধ্যে এক হাজার ৫৪৯ জন গ্রেপ্তার হন। ওই পাঁচ বছরে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২৪ টি মামলা ও ২৬ জন গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে।
গবেষণা অনুযায়ী, অভিযুক্তদের মধ্যে ২৯ শতাংশের বেশি সাংবাদিক ও ৩২ শতাংশ রাজনীতিবিদ। অন্যদিকে অভিযোগকারীদের ৭৮ শতাংশ ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
ওই পাঁচ বছরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানহানির অভিযোগে ১৯০টি মামলা হয়। ফেসবুকে পোস্ট বা মন্তব্য করার দায়ে মামলা হয়েছে ৯০৮টি। বাকি ৫২৮টি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে।
আইন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী স্পিচ অফেন্স সম্পর্কিত মামলাগুলোর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে ২৭৯টি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ৭৮৬টি এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে ২৭৫টি মামলা চলমান রয়েছে।