সাবেক মন্ত্রী মোশাররফের মানহানির মামলায় খালাস পেলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.09.09
ঢাকা
সাবেক মন্ত্রী মোশাররফের মানহানির মামলায় খালাস পেলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার মামলা থেকে খালাস পাবার পর আদালত প্রাঙ্গণে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর সদর আসনের বর্তমান সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ‘নিবর্তনমূলক’ ৫৭ ধারায় দায়ের করা মানহানি মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। 

ফরিদপুর থানায় মামলা দায়ের হওয়ার প্রায় ছয় বছর পর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন বৃহস্পতিবার প্রবীর সিকদারকে নির্দোষ ঘোষণা করেন বলে বেনারকে জানান সাইবার ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম।

এই প্রথমবারের মতো বিতর্কিত ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলায় একজন সাংবাদিক খালাস পেলেন।

অধিকার কর্মীদের মতে, প্রবীর সিকদারের খালাস পাওয়ার ঘটনা ৫৭ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ‘নিবর্তনমূলক’ ধারায় দায়ের করা মামলাগুলো নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রাখবে। 

মামলার রায়ে বিচারক বলেছেন, মামলায় যাদের ‘ভিকটিম’ বলা হয়েছে, তাঁরা নিজেরা এ মামলা করেননি। অথবা তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন কেউ এই মামলার বাদী নন। এমনকি তাঁরা এই মামলায় সাক্ষীও ছিলেন না। মামলা করেছেন দূরের একজন। যিনি এই মামলা করেছেন, তাঁর এটা করার এখতিয়ার নেই।

রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে প্রবীর সিকদার বেনারকে বলেন, “আমি বিচার পেয়েছি। এই রায়ে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার সকল প্রচেষ্টার ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিকদের সোচ্চার হতে হবে। ৫৭ ধারা বাতিল হলেও তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে।”

“দুঃখের বিষয় হলো আমাদের সাংবাদিকরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তাঁরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত, কখনও কখনও সরকারের মুখপাত্রের মতো কথা বলে থাকেন,” বলেন প্রবীর সিকদার।

তিনি বলেন, “উনারা ফরিদপুরে লুটপাট করছিলেন। আমি সেগুলো নিয়ে লেখার কারণে আমার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। সাবেক মন্ত্রীর সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আমি তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ণ করিনি।”

প্রবীর সিকদার বলেন, “আমি নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হলেও পুলিশ জিডি নেয়নি। এই কারণে আমি আমার জীবনের নিরাপত্তার আশঙ্কা তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট দেই। কাউকে অবমাননার জন্য করিনি।”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম বেনারকে বলেন, “আমরা এই রায় মেনে নিয়েছি। আমরা বলছি না যে এই রায়ে আমরা সংক্ষুদ্ধ। পুরো রায় প্রকাশিত হওয়ার পর পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব যে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব কি না।” 

কে এই প্রবীর সিকদার এবং কেন মামলা?

সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীর সিকদার ফরিদপুর জেলায় সাংবাদিকতা করতেন। তিনি জনকন্ঠ, সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাবাসহ পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়।

২০০১ সালে জনকন্ঠ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে প্রতিবেদন করায় তাঁর ওপর আক্রমণ হয়। মারাত্মক জখম হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও একটি পা হারান প্রবীর সিকদার।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফরিদপুর শহরে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখি করতে থাকেন প্রবীর সিকদার। সাংবাদিকতার কারণে হুমকির মধ্যে ছিলেন তিনি।

২০১৫ সালে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশের কাছে সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন প্রবীর সিকদার।

ওই বছর ১০ আগস্ট এক ফেইসবুক পোস্টে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি লেখেন, তাঁর কিছু হলে খন্দকার মোশাররফ, বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের এবং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং তার অনুসারী-সমর্থকরা দায়ী থাকবেন।

স্থানীয় সাংসদ ও তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগে প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট ৫৭ ধারায় মামলা করেন ফরিদপুরের আইনজীবী স্বপন কুমার পাল। 

মামলার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তিনি পরদিন আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান।

২০১৬ সালের ১৬ মার্চ ফরিদপুরের আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. মনির হোসেন। পরে মামলাটি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠান ফরিদপুরের বিচারক। 

একই বছর ৪ আগস্ট ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের এ মামলায় অভিযোগ গঠন করেন বিচারক কে এম শামসুল আলম।

বর্তমানে প্রবীর সিকদার উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং দৈনিক বাংলা ৭১ নামের পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি ঢাকার মিরপুরে বসবাস করেন। 

ঐতিহাসিক রায়

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “এটি আমাদের দেশে সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক রায় বলা যায়। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় শহীদুল আলমসহ অন্যান্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”

তিনি বলেন, “তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কমপক্ষে একশ জন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়েছে এবং জেলে নেয়া হয়েছে; অধিকাংশ মামলার বিচার শেষ হয়নি। এই রায়ের রেফারেন্স ব্যবহার করে অন্যান্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো থেকে সুবিচার পাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”

নূর খান বলেন, “৫৭ ধারা একটি নিবর্তনমূলক ধারা। এর অপব্যবহারের কারণে সরকার এই ধারা বাতিল করেছে। তবে মামলাগুলোর সুরাহা হয়নি।”

তিনি বলেন, “সরকার ৫৭ ধারা বাতিল করেছে। তবে ৫৭ ধারার চেয়ে আরও কঠোর বিধান সংবলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো, মত প্রকাশের সাংবিধানিক স্বাধীনতা খর্ব করা।” 

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুসারে অনলাইন মাধ্যমে যে কোনো উপায়ে কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্র অথবা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করলে অথবা কোনো ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করলে অথবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে এই ধারার অধীনে মামলা করা যাবে। হবে জেল জরিমানা। এই ধারা অজামিনযোগ্য। 

এই ধারার ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করে সরকার। এই আইন পাশের সময় ৫৭ ধারা বাতিল করে সরকার। 

মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন আর্টিকেল-১৯ এর তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ৩৭টি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০২০ সালে সাংবাদিক ও লেখকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৪১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ২৩টি মামলায় ৪১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।