ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পীরের পক্ষে মামলা, আইনটি বাতিলের দাবিতে গণমাধ্যমকর্মীদের মানববন্ধন
2023.07.14
ঢাকা
এক নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি কট্টর ইসলামপন্থী গ্রুপের পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
শুক্রবার ঢাকায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা মানববন্ধন করে বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার অধরা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
সংবাদ প্রকাশের জেরে ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত বন্ধে দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
সাংবাদিকদের ভয়-ভীতি দেখাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছে সিপিজে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিপিজে বৃহস্পতিবার এই বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
সিপিজের বিবৃতি ও সাংবাদিকদের প্রতিবাদ কর্মসূচি এমন সময় হলো যখন বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধনের বিষয়ে বৃহস্পতিবার সকালে সফররত মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
বিতর্কিত এই আইনটি পরিবর্তন এবং অপপ্রয়োগ বন্ধের বিষয়ে দীর্ঘ দিন থেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন আইনমন্ত্রী। এই আইনটি নিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
যে কারণে ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মামলা
রাজধানীর রাজারবাগ পীরকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের ভূমি দখল ও নানা অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ওই পীরের একজন মুরিদ শাকেরুল কবির।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আরটিভিতে এই চক্রের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার প্রতিবেদক ছিলেন ইয়াসমিন। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে ১৩ মে শাকেরুল মামলাটি করেন।
আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে পাঠালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম ১০ জুলাই আরটিভিতে চিঠি পাঠান। তখন মামলাটির সম্পর্কে জানা যায়।
সাংবাদিকতার জন্য হুমকি ডিএসএ
শুক্রবার সকালে ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় সাধারণ গণমাধ্যমকর্মীদের মানববন্ধনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আতঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ওই প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, আইনটি সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি সৃষ্টি করছে এবং নানা ধরনের অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এই আইন বাতিল করতে হবে।
মানববন্ধনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সংশোধন হবে। যেদিন আইন সংসদে উত্থাপিত হয়, সেদিন মোস্তাফা জব্বার (ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী) বলেছিলেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে আইনটি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের এই দুই মন্ত্রী অসত্য বলেছেন।”
তিনি বলেন, আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, “মামলার আগে তদন্ত হবে, তারপর মামলা হবে। কিন্তু অধরার ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি।”
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মোরসালিন নোমানী জানান, রাজারবাগের পীর ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন।
প্রতিবাদের মুখে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সংশোধন করে আরও শক্তিশালী আকারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে বলে দাবি করেন নোমানী।
এ আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরাই গণমাধ্যমের বেলায় ও সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। আর বিরোধী দলে থাকলে স্বাধীনতার কথা বলেন।”
এই অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজারবাগ দরবার শরীফের মুখপাত্র মাহবুবুল আলম আরিফ বেনারকে বলেন, “সাংবাদিক বলেই কারো বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না এমন কোনো কথা নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা ভিত্তিহীন তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ করেছেন বলেই মামলা করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “মামলার তদন্ত শেষেই বোঝা যাবে এসব তথ্যের কোনো ভিত্তি আছে কি না।”
এ বিষয়ে সাংবাদিক ইয়াসমিন বেনারকে বলেন, “সব প্রমাণাদি থাকার পরেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়রানি করার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে। আমার নিউজে সব তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। এই মামলাবাজ সিন্ডিকেট মানুষের জায়গা-সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে ভুক্তভোগীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একেক জনের নামে অসংখ্য মামলা করে।”
তিনি বলেন, “শুরুতে আমি যখন সংবাদটি নিয়ে অনুসন্ধান করছিলাম, তখন আমার ওপর বিভিন্নভাবে চাপ দেয় তারা, যেন সংবাদটি না করি। পরে যখন সংবাদটি প্রকাশ হলো, আমাকে হয়রানি করতে মামলা করল চট্টগ্রামে। আবার মামলাটির তদন্ত গেল নোয়াখালীতে।”
আইন সংশোধনে ফের প্রতিশ্রুতি
দেশ-বিদেশে সমালোচনার মুখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বারবারই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কথা বলে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ঢাকায় সফররত মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে কথা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হবে।”
সরকারের দিক থেকে পর্যালোচনার ভিত্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কথা বলে আসলেও অধিকাংশ বিরোধীরা এর বাতিল চায়।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এই আইনটি এতটাই খারাপ যে, এটিকে সংশোধন করেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তাই আমরা পরিষ্কার দাবি জানিয়ে আসছি; সংশোধন নয়, আইনটিকে বাতিল করতে হবে।”
তিনি বলেন, নানা কথা বলে সরকার সময় নষ্ট করছে এবং আইনটির প্রয়োগ হয়েই যাচ্ছে, এটা দুঃখজনক এবং উদ্বেগের। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় সরকার মূলত এই আইনটি প্রয়োগের মাধ্যমে সুবিধা নিচ্ছে।
গত মাসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেছেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে সাত হাজার মামলা হয়েছে।
সে হিসাবে দেশে প্রতিদিন এই আইনে গড়ে মামলা হয়েছে চারটির বেশি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এই আইনে দায়ের হওয়া এক হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে মামলাগুলোতে মোট আসামি রয়েছেন তিন হাজার ৬৪৪ জন। এদের মধ্যে পেশাগত পরিচয় জানা গেছে এক হাজার ২৯৯ জনের।
পরিসংখ্যানে আরও উঠে এসেছে, পরিচয় চিহ্নিত করা গেছে এমন আসামিদের মধ্যে সাংবাদিক ৩৫৫ জন বা ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সবচেয়ে বেশি আসামি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। সংখ্যা ৪০৩ জন বা ৩১ শতাংশ। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন ১১৮ জন শিক্ষার্থী, যা সাড়ে নয় শতাংশ।