আজান ও নামাজের সময় পূজায় শব্দ সীমিত রাখতে সরকারের চিঠি
2023.10.19
ঢাকা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে পূজায় শব্দ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দেওয়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
যদিও ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর মতে “সবার মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে সতর্কতার জন্যই” এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পূজা উদযাপন কমিটিগুলোকে গত কয়েক দিনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে চিঠি দিয়ে এমন নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টিকে “অসাংবিধানিক” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
“এই ধরনের আহ্বান জানিয়ে সরকারি চিঠি অসাংবিধানিক এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে,” মন্তব্য করে বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে দেশের যে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করেছে।”
সিলেট, গাইবান্ধা, হবিগঞ্জ, ভোলা ও কক্সবাজার জেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের পাঠানো চিঠির অনুলিপি সংগ্রহ করেছে বেনার।
যার একটিতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করা বলা হয়েছে, শুক্রবার জুমাসহ আজান ও অন্যান্য ওয়াক্তের নামাজের সময় মসজিদের পাশের পূজামণ্ডপগুলোতে এবং প্রতিমা বিসর্জনকালে শব্দযন্ত্রের ব্যবহার সীমিত রাখা ও উচ্চস্বরে শব্দযন্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
এসব চিঠির অনুলিপি জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসহ জেলার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তরেও অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে নামাজের ওয়াক্ত বা সময় উল্লেখ করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হবিগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমাদের সব কার্যালয়ে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেই করেছি।”
নামাজের সময়গুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য কিছুটা পরিবর্তনশীল হলেও সাধারণত দিনে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় নামাজের জন্য বরাদ্দ থাকে।
‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখে’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেশে “সংখ্যালঘুদের জন্য স্থান সংকুচিত হয়েছে,” জানিয়ে রানা দাশগুপ্ত বলেন, এই ধরনের চিঠি সংখ্যালঘুদের আরও বেশি দুর্বল করে।
তিনি বলেন, “এই সংকোচনের পেছনে কখনো কখনো রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তির কারণে হামলাকারীরা উৎসাহ পেয়েছে।”
দুর্গা পূজার সময় হিন্দুরা সাধারণত ঢাক-ঢোল বাজায় এবং নারীরা উলু ধ্বনি দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু তরুণরা উৎসবে সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে আনন্দ করে বলে বেনারকে জানান নারায়ণগঞ্জ জেলার চাষাঢ়া এলাকার যুবক শায়ন সাহা।
বিশ্রামের জন্য সংক্ষিপ্ত কিছু বিরতি ছাড়া সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পূজার অনুষ্ঠান চলে জানিয়ে তিনি বলেন, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আমরা সব সময়ই সচেতন থাকি, তারপরও এই ধরনের নির্দেশনা মানসিকভাবে আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখে।”
অন্যান্য বছরও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়: ধর্ম প্রতিমন্ত্রী
পূজায় শব্দ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বেনারকে বলেন, “অন্যান্য বছরও এ রকম নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। এবার লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না হয়।”
তিনি বলেন, “কাউকে ছোট করা নয়, বরং সবার মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে সতর্কতার জন্যই করা হয়েছে।”
এ বছর সারা দেশে ২১টি ট্রাস্টিকে আজান ও নামাজের সময় লাউড স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, বাদ্যযন্ত্র ও উলু ব্যবহার সীমিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান সরকারি প্রতিষ্ঠান হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব কৃষ্ণেন্দু কুমার পাল।
প্রতি বছরই কোনো না কোনোভাবে এই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের পরামর্শে এই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।”
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে, শুক্রবার ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে আগামী মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দুর্গা পূজা। এ বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ৪০৮টি মণ্ডপে পূজা হবে, যার মধ্যে ২৪৪টি মণ্ডপ রয়েছে রাজধানীতে।
গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানায়, ওই দিন পর্যন্ত চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০টি পূজা মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় এবার বেশি সহিংসতার আশঙ্কা করছে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
এর আগে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) স্মারকলিপি দিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাকে যেন ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিন্দুদের ওপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে এক হাজার ৬৭৮টি পূজামণ্ডপ, মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা।
২০২২ সালের জাতীয় জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার প্রায় ৯১ শতাংশ মুসলমান এবং প্রায় আট শতাংশ হিন্দু। বাকিরা বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী।