ফরাসি ওষুধ কোম্পানি স্যানোফির অর্ধেকের বেশি শেয়ার কিনে নিলো বেক্সিমকো ফার্মা

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.01.22
ঢাকা
ফরাসি ওষুধ কোম্পানি স্যানোফির অর্ধেকের বেশি শেয়ার কিনে নিলো বেক্সিমকো ফার্মা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ল্যাবে কাজ করছেন একজন কর্মী।
[ছবিটি বেক্সিমকো ফার্মার মিডিয়া গ্যালারি থেকে নেয়া]

বিশ্বের অন্যতম ওষুধ কোম্পানি স্যানোফি’র অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্যানোফি বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে বাংলাদেশি ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। 

স্যানোফি বাংলাদেশ-এর সাথে বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে প্রায় চার কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কোম্পানিটির ফরাসি অংশের শেয়ারগুলো কিনে নেয় বেক্সিমকো।

বেক্সিমকো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, প্রতিযোগিতামূলক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্যানোফি বাংলাদেশের ১৯ লাখ ৬৩ হাজার ২৪১টি শেয়ার কেনা হয়েছে, যা ওই কোম্পানির মোট শেয়ারের শতকরা ৫৪ দশমিক ছয় ভাগ।

স্যানোফির বাকি ৪৫ দশমিক চার ভাগ শেয়ারের মালিক বাংলাদেশ সরকার।

স্যানোফির শেয়ার কেনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ওষুধ কোম্পানি হিসাবে বেক্সিমকো আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

ব্রিটিশ কোম্পানি মে অ্যান্ড বেকারের অংশ হিসাবে ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশ অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করে কোম্পানিটি। কয়েকটি কোম্পানির সাথে একত্রিত হয়ে ২০০৪ সালে এর নামকরণ করা হয়, স্যানোফি-অ্যাভেন্টিস। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির স্যানোফি বাংলাদেশ নাম ধারণ করে। 

ফরাসি এই কোম্পানিটি উচ্চমানের বিভিন্ন ওষুধ উপাদান করে থাকে। টঙ্গীতে কোম্পানিটির বৃহৎ কারখানা রয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয় স্যানোফি। সেই সূত্র ধরেই বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিলো বেক্সিমকো। 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কমপক্ষে ২৫৭টি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ১৫০টি উৎপাদনে রয়েছে। এই কোম্পানিগুলো দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ উৎপাদন করে থাকে। 

বাংলাদেশের শীর্ষ দশ ওষুধ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, রেনাটা লিমিটেড, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড, এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, অ্যারিস্টো ফার্মা লিমিটেড এবং একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড।

‘আশার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও রয়েছে’

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিজিং কোম্পানি (আইডিএলসি) বাংলাদেশের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে টেকসই বৃদ্ধি ঘটেছে। আগামী পাঁচ বছরে এই খাতে ১৩ থেকে ১৪ ভাগ বৃদ্ধি হবে।

আইডিএলসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আকারের দিক থেকে দেশে বেক্সিমকোর অবস্থান বর্তমানে তৃতীয়। দেশের সর্ববৃহৎ ওষুধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

তবে স্যানোফির প্রায় ৫৫ ভাগ শেয়ার কেনার পর বেক্সিমকোর আয়, মূলধন ও অবস্থানে পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করছেন ওষুধ খাতের বিশেষজ্ঞরা। 

বেক্সিমকো বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। স্যানোফির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে কোম্পানিটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং চর্মরোগের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। আইডিএলসির মতে, এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ওষুধ কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে বেক্সিমকো।

“বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত,” বলে বেনারকে জানান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, এই খাত দেশের মোট ওষুধ চাহিদার কমপক্ষে ৯৭ ভাগ মেটায়, “যার বার্ষিক বাজার মূল্য প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার।”

তাঁর মতে এই কোম্পানিগুলো না থাকলে বাংলাদেশকে তিনগুণ দামে বিদেশ থেকে ওষুধ কিনতে হতো। বর্তমানে এই কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওষুধ রপ্তানি করে থাকে।

দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ায় “আশার পাশাপাশি সামনে চ্যালেঞ্জও রয়েছে,” বলে জানান অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি জানান, উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে উন্নীত হওয়ার পর ওষুধ কোম্পানিগুলো বর্তমানে যে সুবিধা ভোগ করছে তা বন্ধ হয়ে যাবে।

“আমাদের কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত ওষুধের শতকরা ২০ ভাগ জেনেরিক গ্রুপের ওষুধ। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে উন্নীত হওয়ার পর পেটেন্ট ছাড়া এই ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে না,” বলেন তিনি।

তাঁর মতে, “কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা করতে হবে।”

ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে করোনাভাইরাস টিকা আমদানির মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসে বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড। সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ছয় মাসে ভারত থেকে তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাস টিকা আমদানি করবে কোম্পানিটি।

এই আলোচনার ফলে হু হু করে দাম বাড়তে থাকে বেক্সিমকো ফার্মা ও বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের দাম।

ব্রোকারেজ হাউজ আরএন ট্রেডিংয়ের কর্মকর্তা মাহমুদ রুমি বেনারকে বলেন, “দুই মাস আগেও বেক্সিমকো ফার্মার প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ারের মূল্য ছিল ৫০ টাকার নিচে। বর্তমানে এই শেয়ারের মূল্য ২০০ টাকা। একইভাবে, বেক্সিমকো লিমিটেডের ১০ টাকার শেয়ারের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকার ওপরে।”

তিনি বলেন, “এর অন্যতম কারণ বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারত থেকে করোনাভাইরাসের টিকা আমদানি এবং স্যানোফি বাংলাদেশের বৃহৎ অংশের শেয়ার কিনে নেয়া।”

উল্লেখ্য, বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার হলেন সালমান এফ রহমান যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে তাঁর নাম এসেছে। তবে ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির দুটি মামলা থেকে ২০১৭ সালে তিনি অব্যাহতি পান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।