আইএমএফ’র সংস্কার শর্ত: তিন বছরে বাড়তি ২৩ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ
2023.02.13
ঢাকা

বাংলাদেশের রাজস্ব খাত সংস্কারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে কর অব্যাহতি কমিয়ে আনা এবং ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অতিরিক্ত প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার (২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা) রাজস্ব আদায় বড়ো চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর বাইরে অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে—সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রচলিত পদ্ধতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গেলে নিয়মিত করদাতাদের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “সরকারের পক্ষে রাজস্বের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অত্যন্ত দুরূহ হবে। বর্তমান কাঠামো দিয়ে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।”
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঋণ নেওয়ার জন্য আইএমএফ’র তেমন কোনো শর্ত নেই। গত ১৮ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমরা তেমন কোনো শর্তে আইএমএফ-এর ঋণ নিচ্ছি না।”
তবে আইএমএফ জানুয়ারির শেষে ঋণ অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে সংস্কারের যে পরিকল্পনা দিয়েছে তাতে কিছু ক্ষেত্রে সময়সীমাও নির্ধারিত রয়েছে।
সংস্থাটিতে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, “এটিকে শর্তই বলা যায়।”
ব্যবসায়ী নেতা ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও এটি শর্ত হিসেবেই দেখছেন।
আইএমএফ-এর সংস্কার শর্তে সরকারের ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের লক্ষ্যে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার তা বাস্তবায়নও শুরু করেছে। গত জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম দু’দফায় ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৭৯% পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বেনারকে বলেন, “এভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকলে ব্যবসা করা কঠিন হবে।”
ঋণ অনুমোদনের শর্ত হিসেবে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর পরিপালন, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বলেছে সংস্থাটি। সেই লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবার ঋণের কিস্তি ছাড় করার আগে এসব সংস্কারের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুমুখী ঋণদাতা সংস্থাটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয় গত ৩০ জানুয়ারি। এর তিন দিন পরই সংস্থাটি ঋণের প্রথম কিস্তির প্রায় ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র। সাড়ে তিন বছরে মোট সাতটি কিস্তিতে এই ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে।
বড়ো চ্যালেঞ্জ রাজস্ব আদায়ের শর্ত পূরণ
আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রাজস্বের অবদান (ট্যাক্স টু জিডিপি অনুপাত) ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। সংস্থাটি চায় ২০২৬ সালের জুন নাগাদ এই অনুপাত ৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করুক বাংলাদেশ সরকার। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পরবর্তী তিন বছরে অতিরিক্ত ২৩ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আদায় করতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “সরকারের জন্য রাজস্বের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হবে।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “কর অব্যাহতি কমিয়ে আনা অত সহজ হবে না। আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা ওই পর্যায়ে যায়নি।”
বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বেনারকে বলেন, “এত বড়ো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটি অর্জন করতে গেলে যারা বর্তমানের করের আওতায় আছেন, তাঁদের ওপর নতুন করে বাড়তি চাপ তৈরি হতে পারে।”
এনবিআর-এর হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১১ শতাংশ। অথচ আইএমএফ-এর সংস্কার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আদায় বাড়াতে হবে প্রায় ২০ শতাংশ।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন বেনারকে বলেন, “বর্তমান কাঠামোতে রাজস্ব আদায় করতে গেলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়বে।”
এনবিআর থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া আয়কর বিভাগের সদস্য প্রদ্যুৎ কুমার সরকার বেনারকে বলেন, “যে হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে, তা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। এছাড়া বছর বছর যেসব শিল্প বা অন্যান্য খাতকে অব্যাহতি দিয়ে আসা হয়েছে, তা রাতারাতি বাতিল করাও চ্যালেঞ্জিং হবে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনায় বক্তব্য প্রদানকালে বলেন, “আইএমএফ-এর ট্যাক্স টু জিডিপি’র হিসাব নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হয় না। আমরা যে ছাড় (ট্যাক্স এক্সেম্পশন) দিচ্ছি, তার সুবিধা অর্থনীতি পাচ্ছে। আমরা এ হিসাব দেখিয়ে দেবো।”
কর পরিপালন নিশ্চিত করতে যেসব সংস্কার শর্ত দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এনবিআর-এর তিনটি বিভাগের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা, নতুন রিস্ক ইউনিট গঠন ও শুল্ক আইন পাস করা। এসব সংস্কার প্রক্রিয়া এনবিআর ইতোমধ্যে শুরু করেছে।
খেলাপি ঋণ কমানোর তাগিদ
সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২১ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামাতে চায় আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, খেলাপি ঋণের হিসাব আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস অনুযায়ী হতে হবে। বার্ষিক আর্থিক সক্ষমতা প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হিসাব দেখাতে হবে। এটি আগামী জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি মোট ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার পরামর্শ রয়েছে সংস্থাটির। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২১ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। এরপর খেলাপি ঋণ বেড়ে এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামতে না দেওয়াও সরকারের জন্য বড়ো চ্যালেঞ্জ হবে।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের সামান্য উপরে রয়েছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এর আগে ঋণের শর্ত পরিপালন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আইএমএফ-এর অসন্তুষ্টি রয়েছে। বাংলাদেশকে ২০১২ সালে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস অনুযায়ী নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন পাস করতে বলা হয়েছিল। শর্ত পূরণের পর আইনটি কার্যকর করতে সময় লাগে ৭ বছর। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আইনটি সংশোধন করা হয়।”
“সেই কারণে শেষ একটি বা দু’টি কিস্তি ঋণের অর্থছাড় আটকে দিয়েছিল সংস্থাটি। আবার তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে। তবে তার আগে অবশ্যই আলোচনা হবে,” বলেন তিনি।