জরিপ প্রতিবেদন: দেশে দারিদ্রের হার কমেছে, বেড়েছে বৈষম্য
2023.04.12
ঢাকা
ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমে বর্তমানে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়ে অতি দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২ এ এমন তথ্য উঠে এসেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে দারিদ্র্যের হার কমার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।
সরকার সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পরপর এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। জরিপে ২০১৬ সালের আগের বছরগুলোতে যেভাবে দারিদ্র্যের হার কমেছে, সর্বশেষ ২০২২ সালে তাতে কিছুটা ধীর গতি এসেছে।
অর্থনীতিবিদের একটি অংশ এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এই তথ্য (দারিদ্র্যের হার হ্রাস) গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এই সময়ে কোভিড মহামারি ছাড়াও বৈশ্বিক ও স্থানীয় বিভিন্ন কারণে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ছিল। ফলে মানুষের দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসা…গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।”
অর্থনৈতিক বাস্তবতার এমন সময়ে দারিদ্র্যের হার কমার এই উন্নতিকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলছেন আরেক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা যা দেখছি (পারসেপশন) এর সঙ্গে এই উন্নতির (দারিদ্র্যের হার হ্রাস) মিল নেই। এটি যদি সত্যি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক।”
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে এই জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত সরকারের কর্মকর্তারা দারিদ্র্য হ্রাসের বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম হিসেবে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা, দরিদ্রদের জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি ইত্যাদি (কার্যক্রম) দারিদ্র্য হ্রাসে অবদান রেখেছে।”
এর একদিন আগে মঙ্গলবার রাজধানীতে সাংবাদিকদের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “করোনার অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যেই দারিদ্র্যের হার কমে আসার তথ্য প্রমাণ করে অর্থনৈতিকভাবে সঠিক লক্ষ্যেই আছে দেশ।”
পরিসংখ্যান ব্যুরো-এর দুই বছর আগে প্রকাশ করা দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্যের হার না কমে উল্টো বেড়েছে।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল কোভিড মহামারি।
সানেম-এর গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বেনারকে বলেন, “পরিসংখ্যান ব্যুরো’র আগের জরিপের সঙ্গে ২০২২ সালের জরিপের পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না তা পরিষ্কার হওয়া দরকার।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রথম জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ আর অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ শতাংশ। সেই হিসাবে গত পাঁচ দশকে দারিদ্র্য কমার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি দেখিয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০১০ সালে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১০ সালের পরবর্তী এক দশকে দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
জরিপে উঠে এসেছে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী মানুষ শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১০ সালে এটি ছিল ৫৫ শতাংশের সামান্য বেশি। অর্থাৎ এই সময়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।
এদিকে চলতি মাসে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ’পোভার্টি এন্ড ইক্যুইটি ব্রিফ : সাউথ এশিয়া’ এর বাংলাদেশ অংশ বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে দারিদ্র্যের হার অর্ধেক কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, গত এক দশক ধরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য হ্রাস ধীর গতিতে হয়েছে।”
এতে আরো বলা হয়, “কোভিড-১৯ মহামারি দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমিয়ে দিয়েছে। ….যদিও কর্মসংস্থানে গতি বেড়েছে কিন্তু তা কোভিডের আগের অবস্থানে যায়নি।”
বৈষম্য বেড়েছে
জরিপ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেলেও ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য মূলত অর্থনীতির বহুল পরিচিত গিনি সহগ-এ পরিমাপ করা হয়, যা শূন্য থেকে এক এর মধ্যে থাকে। সহগ শূন্য হলে কোনো বৈষম্য নেই। সহগের মান যত এক এর কাছাকাছি যাবে, ততই বৈষম্য বাড়বে।
২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, এই সহগ আগের এক দশকে দুই দফায় জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের চেয়ে আয় ও ভোগ ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই বেড়েছে। অর্থাৎ বৈষম্য বেড়েছে।
এই বৈষম্যের বিষয়টি স্বীকার করে পরিকল্পনামন্ত্রী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “এটি গ্রহণযোগ্য নয়, বৈষম্য কমাতে হবে। আমি মনে করি, জনগণ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে পিছিয়ে থাকলে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।”
এই বৈষম্য বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন না ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক।
বেনারকে তিনি বলন, “বৈষম্য যে বাড়ছে তা দৃশ্যমান। সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। সমাজের বর্তমান অবস্থা বৈষম্যকে উসকে দেবেই। এটিকে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।”
অবৈধ সম্পদ গড়ার রাস্তা বন্ধ করা এবং সঠিক কর নীতির মাধ্যমে বৈষম্য কমানো যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়ে তিনি এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ, সম্পদের ওপর কর আরোপ এবং অবৈধ সম্পদ আহরণের রাস্তা বন্ধ করতে হবে।”
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সালের তুলনায় মানুষের মধ্যে খাদ্য হিসেবে ভাত ও রুটি (গম) খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তবে একই সময়ে কমেছে মাংস, ডিম, ডাল ও শাক-সবজি খাওয়ার পরিমাণ। এর মধ্যে ডিম খাওয়ার পরিমাণ কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
তবে মাছ, দুধ ও দুধ জাতীয় পণ্য এবং ফল খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।