প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে টান, ফের চাপ বাড়তে পারে রিজার্ভে

রিয়াদ হোসেন
2023.05.04
ঢাকা
প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে টান, ফের চাপ বাড়তে পারে রিজার্ভে ঢাকার কমলাপুরের কনটেইনার ডিপোতে সমুদ্রবন্দরগামী মালবাহী রেলগাড়িতে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কনটেইনার তোলা হচ্ছে। ২ অক্টোবর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎস রপ্তানি খাত থেকে সদ্য সমাপ্ত এপ্রিলে আয় কমেছে, প্রবাসী আয়েরও অবস্থা একই। অর্থনীতি খাত সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এতে রিজার্ভের ওপর আবারও চাপ বাড়তে পারে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত এপ্রিলে রপ্তানি আয় কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ। একই সময়ে প্রবাসী আয়ও কমেছে ১৬ শতাংশ। এর আগের মাসেও রপ্তানি আয় কমেছিল।

ইপিবি’র হিসাবে, এপ্রিলে বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ৩.৯৫ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল প্রায় ৪.৭৪ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ১.৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগামী আগস্টের আগে রপ্তানিতে গতি ফেরার সম্ভাবনা নেই।

এসব কারণে “রিজার্ভের ওপর আগামী দিনগুলোতে চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বেনারকে বলেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক।

বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। মার্চের পর এপ্রিলেও এই খাতের রপ্তানি কমার কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বেনারকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফলে মানুষকে পোশাক ক্রয়ের চেয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এই কারণে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে।”

পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বেনারকে বলেন, “বর্তমানে রপ্তানি আদেশ ৩০ শতাংশ কম। আগামী আগস্টের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।”

প্রবাসী আয় কমার কারণ হুন্ডি

পরবর্তী কয়েক মাসে পোশাক রপ্তানির গতিধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় রপ্তানিকারকদের কাঁচামাল ব্যবহারের ঘোষণার ওপর, যা ইউটিলিটি ডিক্লারেশন বা ইউডি হিসেবে পরিচিত। পোশাক খাতের দুইটি সংগঠন এই হিসাব সংরক্ষণ করে। শহীদুল্লাহ আজিম জানান, ইউডি বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ কম রয়েছে।

এর অর্থ হলো আগামী মাসগুলোতেও রপ্তানি কমতির দিকে থাকতে পারে। রপ্তানির বাইরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বড়ো উৎস প্রবাসী আয়, যা সাধারণত ঈদের মাসে বাড়ে।

এবার ঈদের মাস হওয়া সত্ত্বেও তা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বেনারকে বলেন, “আমরা বিশ্লেষণ করছি, কোন কোন দেশ থেকে কমল।”

পরবর্তী মাসগুলোতে প্রবাসী আয় বাড়বে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পেছনে ডলারের বিনিময় হার বাজার মূল্যের তুলনায় বেশি হওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

প্রবাসী আয় কমে যাবার “বড়ো কারণ হুন্ডি” উল্লেখ করে তিনি বেনারকে জানান, হুন্ডিতে ডলারের সরকার নির্ধারিত দরের তুলনায় “১৩ থেকে ১৪ টাকা বেশি।

সরকার নতুন করে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে টাকার দর এক টাকা বাড়িয়েছে। ফলে প্রবাসী আয় বাড়ার ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে, যা প্রকারান্তরে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াবে বলে মনে করেন তিনি।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকলে ডলারের ওপর চাপ বাড়ে। এক পর্যায়ে ডলার সংকট দেখা দিলে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে শুল্ক বাড়ানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়।

তাতে আমদানি কমলেও কার্যত ডলার সংকট কাটেনি। ফলে ক্রমাগত কমতে থাকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান। বাধ্য হয়ে সরকার দফায় দফায় টাকার অবমূল্যায়ন করে, যা সর্বশেষ ২৫ শতাংশ ঠেকেছে। তবুও পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার এখনো সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

বিষয়টি স্বীকার করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “যেহেতু আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই। কারো হয়তো ১০০ ডলার প্রয়োজন, আমরা ৫০ বা ৬০ ডলার দিচ্ছি। পুরো সাপোর্ট দিতে পারছি না।”

রিজার্ভ নামবে ৩০ বিলিয়নের নিচে

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সর্বশেষ ২ মের হিসাব বলছে, রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে।

এশিয়ার নয়টি দেশ থেকে আমদানির অর্থ পরিশোধ বাবদ চলতি সপ্তাহে আরও এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে, যা আকু পেমেন্ট নামে পরিচিত। ওই অর্থ যাওয়ার পরে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে।

মেজবাউল হক বলেন, “চলতি সপ্তাহে এক দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আকু পেমেন্ট করা হবে। তাহলে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামবে।”

এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমফ) বাংলাদেশকে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়ার সময় যেসব সংস্কারের পরিকল্পনা দিয়েছে, তার মধ্যে রিজার্ভ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিমাপের কথা বলেছে। সে ক্ষেত্রে রিজার্ভ আরও কমবে বলে মনে করেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে

ডলারের বিপরীতে গত এক বছর ধরে ক্রমাগত টাকার অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি পণ্যের বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। গত আগস্টেই দেশের মানুষ ১২ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যানে ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ওই মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের উপরে আছে। এমন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ফের এক টাকা করে টাকার দর কমানো হয়েছে।

এ ছাড়া আগামী জুনে বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।

ড. রাজ্জাক বলেন, “সার্বিকভাবে যদি ফের টাকার অবমূল্যায়ন হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। কেননা আমদানি পণ্যের ব্যয় বেড়ে যাবে।”

টাকায় বিমান ভাড়া নির্ধারণ

বাংলাদেশ সরকার বিদেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বিমান ভাড়া নির্ধারণে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা টাকা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আগামী ১ জুলাই থেকে যা কার্যকর হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম উঠানামা করায় যাত্রীর আর্থিক ক্ষতি ঠেকাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অবশ্য গত ১৬ এপ্রিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিমান ভাড়া নিজস্ব মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও দেশীয় মুদ্রা হিসেবে টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “ডলারে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হলে পরবর্তীতে টাকার বিপরীতে উঠানামা করায় ক্রেতার আর্থিক ক্ষতি হয়। টাকায় করার ফলে তা স্থির রাখার সুযোগ তৈরি হবে। এতে যিনি টিকেট ক্রয় করবেন, তিনি হয়তো কিছুটা রেহাই পাবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।