প্রবাসীদের পাঠানো টাকার পরিমাণ কমেছে, অন্যতম কারণ হুন্ডি

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.06.13
ঢাকা
প্রবাসীদের পাঠানো টাকার পরিমাণ কমেছে, অন্যতম কারণ হুন্ডি বিদেশ যাওয়ার আগে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি কর্মীদের অপেক্ষা। ১৩ জানুয়ারি ২০২২।
[বেনারনিউজ]

চলতি অর্থ বছরে কমেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো টাকার (রেমিটেন্স) পরিমাণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত এগারো মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থ বছরের (জুলাই ২০২০- জুন ২০২১) ১১ মাসের তুলনায় তিন দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার কম।

বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে এবং বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন বিলাস পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনীয় সব প্রকল্প বাদ দেয়ার মধ্যেই রেমিটেন্স প্রবাহের ঘাটতির কথা জানা গেলো।

অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেশ কমে যাওয়ার ফলে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন এরই প্রভাবে কমেছে রেমিটেন্স।

বাংলাদেশে টাকার অংকে আমদানি-রপ্তানির যে ব্যবধান তা মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে পূরণ হয় বলে বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।

বর্তমান অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ও রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার হবে। ফলে এই অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি হবে ৩৫ বিলিয়ন ডলার বলে জানান তিনি।

“এই ৩৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রেমিটেন্স থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার আসার পরও আমাদের ১৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি থাকবে,” বলেন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।

কার্ব মার্কেটে বা খোলা বাজারে ডলারের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধিই বর্তমান অর্থ বছরে রেমিটেন্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অভিবাসন কর্মীদের কল্যাণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সাইফুল হক।

ডলারের এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রবাসীরা অনানুষ্ঠানিক হুন্ডির মাধ্যমে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

“একজন প্রবাসী ব্যাংক অথবা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠালে প্রণোদনার অর্থসহ এক ডলারের বিপরীতে পাবেন ৯৪ টাকা। অন্যদিকে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পাঠালে কোনো প্রেরণ খরচ ছাড়াই প্রতি ডলারের বিপরীতে একশ’ টাকার কাছাকাছি পাচ্ছেন,” বেনারকে বলেন সাইফুল হক।

হুন্ডির পেছনে ‘ভিসা ব্যবসা

বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া হুন্ডি হিসাবে পরিচিত। এই প্রক্রিয়া সরকার বা প্রথাগত ব্যাংকের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। ফলে রাষ্ট্র রেমিটেন্স প্রেরণকারীর কাছ থেকে কোনো ফি আদায় করতে পারে না।

হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশি অংশীদাররা নির্ধারিত ঠিকানায় প্রবাসীর পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার সমমূল্যের বাংলাদেশি টাকা পরিশোধ করেন, বিদেশি অংশীদাররা প্রবাসীর কাছ থেকে বুঝে নেন বৈদেশিক মুদ্রা।

হুন্ডিতে টাকা পাঠালে প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আসে না। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ডলারের বিপরীতে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে টাকার বেশি দর দিয়ে থাকেন।

হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বেশি দরে বৈদেশিক মুদ্রা কেনার মূল কারণ ‘ভিসা ব্যবসা’ বলে বেনারকে জানান ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের সাইফুল হক।

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “কোনো সৌদি নাগরিক যদি তার সরকারের কাছ ২০টি কর্মী ভিসা বের করতে পারে, তাহলে তিনি বাংলাদেশি দালালদের সাথে যোগাযোগ করেন। দালালরা ওই ভিসা কিনে নেন এবং তাদের রিয়াল দিয়ে ভিসা কিনতে হয়। সে ওই রিয়াল পাবে কোথায়?”

এরকম পরিস্থিতিতে দালালরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বেশি দরে রিয়াল অথবা ডলার কেনেন বলে জানান তিনি।

পরবর্তীতে বাংলাদেশি কর্মীদের কাছে ওই ভিসাগুলো “উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে,” দালালরা ঘাটতি সমন্বয় করেন বলে জানান সাইফুল হক।

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। আমদানি কমে যায়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

তবে মহামারি পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় বর্তমান অর্থবছরে আমদানি প্রায় শতকরা ৪৪ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ডলারের ওপর চাপ পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৪২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

এদিকে গত কয়েক মাসে প্রতিনিয়ত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকায় এক ডলারের বিপরীতে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে সাড়ে ৯৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কিছুদিন আগে কার্ব মার্কেটে এই মূল্য ১০৪ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

ব্যাংকগুলো ডলার দেয় না

ডলার বিক্রেতা ও মতিঝিলের বাশার এন্টারপ্রাইজের মালিক আবুল বাশার বেনারকে বলেন, সোমবার এক ডলারের বিপরীতে ক্রেতাদের কাছ থেকে ৯৮ টাকা ৭০ পয়সা নিচ্ছেন। অন্যদিকে বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনছেন ৯৭ টাকায়।

তিনি বলেন, “পর্যটন, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ বিদেশ যাচ্ছেন। একজন মানুষ কোনো ঘোষণা ছাড়াই পাঁচ হাজার ডলার নিয়ে যেতে পারেন।”

“বর্তমানে ডলারের দাম বাড়ার কারণ মানুষ ব্যাংক থেকে ডলার পায় না। ব্যাংকগুলো ডলার দেয় না, বলে ডলার নেই,” বলেন বাশার।

তিনি বলেন, ব্যাংক যদি ৯৩ টাকায় ক্রেতাদের ডলার দিতো তাহলে মানুষ কি বেশি টাকা দিয়ে আমাদের কাছ থেকে ডলার কিনত?”

রেমিটেন্স প্রবাহ ঠিক আছে

বর্তমানে বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ ঠিক আছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিটেন্স এসেছিল ২৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে দুই বিলিয়ন ডলার জানিয়ে তিনি বলেন, “এই পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ ছিল করোনাভাইরাস মহামারি।”

“মহামারির কারণে প্রবাসীরা বাংলাদেশে তাঁদের পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বেশি বেশি টাকা পাঠিয়েছেন। আবার করোনার কারণে যাঁরা চাকুরি হারিয়েছেন তাঁরা বিদেশে তাঁদের সব কিছু বিক্রি করে টাকা দেশে পাঠিয়ে ফিরে এসেছেন,” জানান তিনি।

চলতি বছরের ১১ মাসে যে পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে তা “কম নয়” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা যদি ২০২০-২১ অর্থবছরের সাথে বর্তমান রেমিটেন্সকে তুলনা করি তাহলে সেটি ঠিক হবে না। তুলনা করতে হবে করোনা মহামারির আগের রেমিটেন্স এর সাথে।

রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে ২০১৯-২০ সালের বাজেটে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের বিপরীতে শতকরা দুই ভাগ প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এই সিদ্ধান্তের কারণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের প্রবাহ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এই বছর আট লাখ মানুষ বিদেশ গেছেন জানিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাঁরা যখন টাকা পাঠাতে থাকবেন তখন রেমিটেন্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

“আমার মনে হয় আগামী অর্থবছর থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়বে,” বলেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।