ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতের সাথে রুপিতে লেনদেন শুরু
2023.07.11
ঢাকা

বৈদেশিক বাণিজ্যে বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দেশটির মুদ্রা রুপিতে লেনদেন শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উভয় দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির অর্থ পরিশোধের লক্ষ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন হয়।
দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে এ পদ্ধতিকে ‘বিশাল সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।
তিনি বলেন, “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।”
দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে এটিকে নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলেও অভিহিত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ঝুঁকিতে থাকা ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে রুপির লেনদেন।”
গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির ব্যয় ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। সেই চাপ পড়ে ডলারের ওপর। ফলে নামতে থাকে প্রায় ৫০ বিলিয়নের কাছাকাছি চলে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
অন্যদিকে এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকা দর হারায় প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে আমদানিতে ব্যয় বাড়তে থাকে।
আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেও রিজার্ভ ও টাকার দরপতন ঠেকানো যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে চলতি জুলাই মাসের শুরুর দিকে রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসাব করলে তা আরও কম।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত কয়েক মাস ধরেই ডলারের বিপরীতে আমদানি-রপ্তানির লেনদেন বিকল্প মুদ্রায় করার উপায় খুঁজছিল বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে (আরএমবি) লেনদেন শুরু করার পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গেও গত কয়েক মাস ধরে বিস্তর আলোচনা হয় রুপি ও টাকা লেনদেনের বিষয়ে।
প্রাথমিকভাবে রুপিতেই লেনদেন প্রক্রিয়া শুরু হলো। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, শিগগির টাকাতেও লেনদেন শুরু হবে।
লেনদেন হবে ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে উভয় দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ১৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের আর রপ্তানি করেছে দুই বিলিয়ন ডলারের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ যে পরিমাণ রপ্তানি করেছে, কেবল ওই পরিমাণ অর্থের লেনদেন করা যাবে রুপিতে। ভারত থেকে বাকি আমদানি পণ্যের অর্থ ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি যত বেশি বাড়বে, তত বেশি ডলারের পরিবর্তে রুপিতে লেনদেনের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ।
উদ্বোধনী দিনে যে দুটি প্রতিষ্ঠানে রুপিতে লেনদেনের মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু করেছে, তার একটি নিটা কোম্পানি লিমিটেড মাতলুব আহমাদের মালিকানাধীন।
বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি চলতি, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হবে। তখন তিন বিলিয়ন ডলারের লেনদেন রুপিতে নিষ্পত্তি করা যাবে।”
ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞ ও ভারতের সঙ্গে লেনদেন রয়েছে এমন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে এ লেনদেন নিষ্পত্তি করা যাবে।
এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ভারতের ব্যাংক দুটিতে হিসাব খুলেছে, যা নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট নামে পরিচিত। ওই হিসাবে রুপি থাকবে। ভারতের কোনো ব্যবসায়ী যদি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে চান, তাহলে তিনি সেখানকার ওই ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র বা এলসি খুলবেন।
একইভাবে বাংলাদেশের দুটি ব্যাংকে ভারতের ব্যাংকগুলো যে হিসাব খুলবে, তা হবে ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট। উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানির সমপরিমাণ রুপি এই ব্যাংকগুলোর হিসাব থেকে নিষ্পত্তি করা হবে।
ডলারের বিনিময় হারের ভিত্তিতেই মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে হবে জানান আব্দুল মাতলুব আহমাদ।
ব্যয় কমবে, আশা ব্যবসায়ীদের
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি-রপ্তানিতে ডলার, টাকা ও রুপি এই তিন মুদ্রায় বিনিময়ের কারণে যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তার তুলনায় সরাসরি রুপিতে লেনদেন হলে ব্যয় কমবে।
ভারতে আমদানি-রপ্তানি; দুই ধরনের ব্যবসা রয়েছে নারায়ণগঞ্জভিত্তিক নিটওয়্যার পোশাক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেমের। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে আমাদের ৫ শতাংশের মতো সাশ্রয় হতে পারে।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, এতে ডলারের ওপর চাপ কমবে।
ঠিক কত পরিমাণ ব্যয় কমবে সে বিষয়ে কোনো ধারণা না দিলেও ভারতের হাইকমিশনার বলেন, “এতে বিনিময় ব্যয় ও সময় সাশ্রয় হবে এবং ব্যবসা সহজীকরণেও সহায়ক হবে।”
চালু হচ্ছে টাকা-রুপি কার্ড
আগামী সেপ্টেম্বর থেকে দুই মুদ্রায় ‘টাকা-রুপি কার্ড’ চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “টাকা–রুপিতে আমরা ডুয়েল কারেন্সি কার্ড চালুর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। সেপ্টেম্বরে এটি চালু করা যাবে।”
এর ফলে ডলার সাশ্রয় হবে বলেও জানান তিনি।
এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতে যারা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন কাজে ভ্রমণ করবেন, তাদের জন্য বিনিময় হারে কিছুটা সাশ্রয় হবে, কেননা তাদের আর ডলারে রূপান্তর করতে হবে না।