ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের দামে বড়ো ব্যবধান, বেড়েছে হুন্ডি

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.08.03
ঢাকা
ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের দামে বড়ো ব্যবধান, বেড়েছে হুন্ডি কর্মস্থলে যেতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশের জন্য প্রবাসী শ্রমিকদের লাইন। ২১ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

ব্যাংকিং চ্যানেল ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে বড়ো ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ার কারণে বাড়ছে হুন্ডি, যার পরিমাণ মোট রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেক বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তাফা কামাল জানান, বিদেশ থেকে ব্যাংকসহ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসে তা প্রকৃত রেমিটেন্সের ৫১ শতাংশ, বাকি ৪৯ শতাংশ আসে অনানুষ্ঠানিকভাবে বা হুন্ডির মাধ্যমে।

বাংলাদেশে হুন্ডি সম্পর্কে এটিই কোনো অর্থমন্ত্রীর সুস্পষ্ট বক্তব্য, যদিও এ ব্যাপারে সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো গবেষণা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন না করলেও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সময়ে বিবেচনায় নিলে হুন্ডি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক।

প্রতি বছর বাংলাদেশে কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে, যা দেশের বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে বড়ো ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর সদ্যসমাপ্ত জুলাই মাসে দুই দশমিক এক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

সাংবাদিক সম্মেলনে আ. হ. ম. মুস্তাফা কামাল বলেন, “আমরা সব সময় অফিসিয়াল চ্যানেলে বিদেশ থেকে টাকা আসুক, সেটা প্রত্যাশা করি। হুন্ডির মাধ্যমে যদি কেউ টাকা নিয়ে আসেন, সেটি অবৈধ বলব না, তবে সেটি কালো টাকা। যারা সেই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে আসেন, তারা সব সময় বিবেকের কাছে দায়ী থাকবেন।”

হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকার পরিমাণ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমি আগে একটি স্টাডি করে দেখেছিলাম, প্রায় কাছাকাছি অফিসিয়াল চ্যানেলে এসেছে ৫১ শতাংশ আর হুন্ডিতে এসেছে ৪৯ শতাংশ। সেজন্য আমি মনে করি সেই ধারাবাহিকতা এখনো আছে।”

হুন্ডি হলো অনানুষ্ঠানিকভাবে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর একটি অবৈধ প্রক্রিয়া।

হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশি অংশীদাররা নির্ধারিত ঠিকানায় প্রবাসীর পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার সমমূল্যের বাংলাদেশি টাকা পরিশোধ করেন, বিদেশি অংশীদাররা প্রবাসীর কাছ থেকে বুঝে নেন বৈদেশিক মুদ্রা।

হুন্ডিতে টাকা পাঠালে প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আসে না। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ডলারের বিপরীতে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে টাকার বেশি দর দিয়ে থাকেন।

ডলারের দামে বিরাট ব্যবধান

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থন করে অভিবাসন কর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, বর্তমানে হুন্ডির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার অন্যতম কারণ “ব্যাংকিং চ্যানেল এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে বিরাট ব্যবধান।”

তিনি বলেন, “ব্যাংকিং চ্যানেলে বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে দেয়া হচ্ছে ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা। শতকরা আড়াই ভাগ প্রণোদনা ধরে সেটি হয়তো ৯৬ টাকা হবে। অন্যদিকে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিপরীতে দেয়া হচ্ছে ১১২ টাকা।”

সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, ইরাক, সিঙ্গাপুরসহ সব জায়গার প্রবাসীদের ঝোঁক এখন “হুন্ডির দিকে,” বলেও জানান তিনি।

এছাড়া কিছু কিছু দেশ থেকে বাংলাদেশিরা হুন্ডি ছাড়া অন্য কোনোভাবে দেশে টাকা পাঠাতে পারে না জানিয়ে তিনি বলেন, “ইরাক, লিবিয়ায় আমাদের কর্মীরা ব্যাংকিং সুবিধা পায় না। সুতরাং, তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বাধ্য।”

বাগদাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব অহিদুজ্জামান লিটন বেনারকে বলেন, এটা সত্য যে, ইরাকে অবস্থিত বাংলাদেশি কর্মীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে সমস্যার মুখোমুখি হন। ইরাকের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রথমে সেটি দুবাইয়ের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যায়। এরপর সেখান থেকে বাংলাদেশে টাকা যায়। এ ছাড়াও, টাকা পাঠাতে বেশ বড়ো অংকের ফি জমা দিতে হয়।

ইরাকে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তাঁদের মধ্যে যাঁরা বসরায় কিছু কোম্পানিতে কাজ করেন তাঁরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠান। বাগদাদে যাঁরা থাকেন তাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান বলে আমরা খবর পাই।”

লিটন বলেন, “যেসব কর্মীর কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন, তাঁরা তো হুন্ডি ছাড়া আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারবেন না।”

ইরাক থেকে টাকা পাঠানো সহজ করতে বাগদাদে অগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখা খোলার উদ্যোগ নেয়া হলেও “সেটি এখনও খোলা সম্ভব হয়নি” বলে জানান লিটন।

কোনো গবেষণা নেই

অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের সাথে “সম্পূর্ণ একমত নই” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর।

তাঁর মতে, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক হলে বাংলাদেশের প্রকৃত বার্ষিক রেমিটেন্সের পরিমাণ হবার কথা প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। কারণ বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রতিবছর ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে। অর্থমন্ত্রীর হিসাবে আরো প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার আসে হুন্ডির মাধ্যমে।

“হুন্ডি বাংলাদেশে সব সময় ছিল, এখনও আছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের ব্যবধান বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়ায় লেনদেন বেড়েছে।”

“তবে যতই বৃদ্ধি পেয়ে থাক না কেন, হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠানো টাকার পরিমাণ কোনক্রমেই ২২ বিলিয়ন ডলার হবে না,” বলেন আহসান এইচ. মনসুর।

তিনি বলেন, “আর যদি প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ রেমিটেন্স হুন্ডি হয়ে আসে তাহলে বোঝা যাবে আমাদের ব্যবস্থায় সমস্যা আছে। সেটি বন্ধ করতে হবে।”

এদিকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে কী পরিমাণ রেমিটেন্স আসে তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই বলে বুধবার বেনারকে জানান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

সে কারণে “অর্থমন্ত্রীর কথা সঠিক কি না সেটি বলা খুব মুশকিল,” জানিয়ে তিনি বলেন, “গবেষণা ছাড়া এই কথা সঠিক বলা যথার্থ হবে না।”

তাঁর মতে, “হুন্ডি বন্ধ করার মূল উপায় হলো ব্যাংকিং চ্যানেল এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা। মানুষ যখন দেখবে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে তাঁরা কম টাকা পাচ্ছেন, তখন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন।”

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় সব সময় রপ্তানি আয়ের চেয়ে বেশি। ফলে আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানি আয়ের মধ্যে ফারাক রয়ে যায়। দেশে রপ্তানি ব্যয় মেটানোর অন্যতম উৎস হলো প্রবাসীদের পাঠানো টাকা বা রেমিটেন্স।

সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ব্যয় প্রায় ৯৭ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার।

এর মধ্যে রেমিটেন্স থেকে এসেছে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। এরপরও বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার।

এই ঘাটতি পূরণ করতে সরকার আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প স্থগিত করেছে।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) এর কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে সরকার। এ ছাড়াও, বিশ্ব ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।